কাঠের পা -আনােয়ারা সৈয়দ হক


আমার বাবা মুক্তিযােদ্ধা। নয় নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন শাজাহানের নেতৃত্বে যে বিশাল মুক্তিবাহিনীর দল গড়ে উঠে, বাবা ছিলেন তাদের একজন। ক্যাপ্টেন শাজাহান ছিলেন দুর্বৰ মুক্তিযােদ্ধা। বরিশালের বিভিন্ন জায়গায় ছিল তার বাহিনীর তৎপরত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপরে যখন তখন আক্রমণ চালিয়ে ক্যাপ্টেন শাজাহান ও তার গ্রুপ তাদের নাজেহাল করে তুলতেন। বাবা ছিলেন খুব নামকরা মুক্তিযােদ্ধা। তেমনি সাহসী। বাবা বয়সে বড় হলেও ক্যাপ্টেন শাজাহান বাবাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। একবার হলাে কী, খালের ওপারে ক্যাম্প বসাল পাকিতানি মিলিটারি। তাদের সঙ্গে অনেক রাজাকার। রাজাকাররা তখন অবস্থা খারাপ বুঝে মিলিটারিদের সাথে সাথে ঘুরত। ভাবত, বুঝি অস্ত্রের সাথে সাথে থাকলে তারা নিরাপদে থাকবে। যাই হােক, ক্যাপ্টেন শাজাহান স্থির করলেন রাতের বেলা খাল পেরিয়ে তাদের আক্রমণ করবেন। 

সেই হিসেবে আমার সাহসী বাবাকে আগের দিন ব্লেব্ধি করতে পাঠানাে হলাে। বাবার পরিবেশজ্ঞান ছিল খুব তীক্ষ্ণ। সন্ধ্যেবেলা গােপনে খাল পার হয়ে বাবা ওপারে গিয়ে দেখলেন বিস্তীর্ণ মাঠ। বাবা জঙ্গলের ধার ঘেঁষে মাঠ পার হতে লাগলেন। আর সেই সময় ঘটল বিস্ফোরণ। মাঠের দুধারে ছিল মাইন পাতা, যা বাবা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। মাইনের উপরে সরাসরি পা ফেলতেই বিস্ফোরণে বাবার দুটি পা-ই হাঁটুর নিচ থেকে উড়ে গেল। বাবা জ্ঞান হারালেন। বাবার পেছনে ছিলেন অর-একজন মুক্তিযােদ্ধা। তিনি বাবাকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে গেলেন গহিন জঙ্গলের ভিতরে। সেখান থেকে পরে তাদের উদ্ধার করা হলাে। বাবার মুক্তিযােদ্বা জীবনের সেখানেই হলাে ইতি। এই ঘটনার পর বাবাকে সীমান্তের ক্যামেপাঠিয়ে দেয়া হলাে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা হলাে বাবার। দুটো নকল পা তৈরি করে দেয়া হলাে বাবাকে। কাঠের নকল পা। 

হাতে লাঠি নিয়ে, কাঠের পা লাগিয়ে বাবা আমার নতুন করে হাঁটতে শিখলেন। আস্তে আস্তে এই কষ্ট সয়ে গেল বাবার। বাবা যখন মুক্তিযুদ্ধে, আমি তখন খুব ছােট্ট। এক বছর হয়েছে কি-না সন্দেহ। তাই মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বাবা আমাকে কোলে তুলতেই আমি ভ্যাক করে কেঁদে সারা। আর বাবাও আমাকে কোলে তুলে অপ্রস্তুত। তারপর আস্তে আস্তে বাবার সাথে ভাব হলাে। এখন আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু, বাবা। আর বাবার বন্ধু, আমি। বাবাকে আমি খুব ভালােবাসি। তবু মনে হয় কোথায় যেন ফাক থেকে যায়। 

আমাদের বাড়িতে শুধু আমি আর বাবা থাকি। সরকার কিছু অনুদান দেন। আর বাবা বাড়ি বসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্যে কি সব রিপাের্ট তৈরি করেন। এই দিয়ে আমাদের সংসার চলে। দাদা বাবার জন্যে ছােট একটা বাড়ি রেখে গেছেন। আমাদের তাই বাড়িভাড়া লাগে না। আমার বয়স ষােল। বাবার বয়স তেতাল্লিশ। আমি এইবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষা মােটামুটি হয়েছে। খুব একটা লেখাপড়া করতে আমার মন চায় না। বাবা মন খারাপ করবেন ভয়ে আমি পড়ি। আমাদের বাড়িটা কী নির্জন। খাঁচায় একটা ময়না পাখি পুষেছি। বেশির ভাগ সময় আমি তার সঙ্গেই কথা বলি। তাকে ছােলা খেতে দিই। সে আমাকে নয়ন, ও নয়ন বলে ডাকে। আমার ডাকনাম নয়ন। বাবা সারাটা সকাল বইপত্তর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। বাসায় একটা কাজের বুয়া আছে। সে রান্নাবান্না করে। 

আমি আর বাবা খাই। দুপুরে বাবা ঘুমােতে চলে গেলে, সারা বাড়িতে আমি একা। আমার এই-ই ভালাে লাগে। বিকেলে আমার বন্ধু নিয়ামত আসে। আমরা বাড়ির সামনের মাঠে কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলি। সন্ধ্যের আগে আগে চলে যায়। তারপর আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখি বাবা আমার জন্যে চা-নাস্তা সাজিয়ে বসে আছেন। নাস্তা শেষ হলে আমি আর বাবা গল্প করি।কত গল্প, কত রকমের গল্প। যদিও সেগুলাে সত্যি ঘটনা, তবু গল্পের সেরা। উনিশ শাে একাত্তরে আমাদের দেশে যে অবিশ্বাস্য মুক্তিযুদ্ধ ঘটে গেছে তার বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে গল্প করেন বাবা। বাবা বলেন এই দেশের শহরে-গ্রামে , মাঠে-ঘাটে, খালে-বিলে ,নদীতে-হাওড়ে , পাহাড়ে-জলাভূমিতে ঘটে গেছে মুক্তিযােদ্ধাদের হাজারাে রকমের ‘অপারেশন', যা ইতিহাস হয়ে আছে। আমার ইচ্ছে আমি আর একটু বড় হয়ে এই ইতিহাস পড়ব ।

বাবা এক ঘরে ঘমােন আমি অন্য ঘরে। আগে বাবা আর আমি এক ঘরে ঘমােতাম। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আগে আমার ঘর আলাদা করে দিয়েছেন বাবা, যাতে আমি অনেক রাত জেগে লেখাপড়া করতে পারি। সেই থেকে আমি পাশের ঘরে শুই।। বড়দের মতাে আলাদা ঘরে শুতে আমার ভালাে লাগে। আবার বাবার ঘরে শুয়ে শুয়ে গল্প করতেও ভালাে লাগে। কোনাে কোনােদিন বাবাকে চিনতে পারিনি। চেনা বাবা হঠাৎ করে অচেনা হয়ে যান। এরকম হলে সেদিন আর আমার সাথে বেশি কথাটথা বলেন না বাবা। বই পড়েন না। রিপাের্ট লিখেন না। পাখির খাঁচার সামনে দাঁড়ান না। পাখিটাকে কথা বলা শেখান না। শুধু চুপচাপ জানালা দিয়ে একমনে তাকিয়ে থাকেন। সেদিন বাবার মন খারাপ হয়। আমি সেদিন সারাদিন বাবার আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করি। বাবার জন্যে আমার মন কেমন যে করে। বাবাকে খুশি করার জন্যে কত রকমের ফন্দি আঁটি। কিন্তু কোনােটাই করা হয়ে উঠে না। | সেইদিনটাও ছিল যেন বাবার মন খারাপের দিন। সেদিন আবার আকাশে চাঁদ উঠছে খুব বড় হয়ে। পূর্ণিমা- টুর্ণিমা। ও হবে। বাবা সারাদিন চুপ করে বসে ছিলেন। রাতে আমি সাহস করে বাবার কাছে গিয়ে বললাম, বাবা, ছাদে যাবে।

বাবা আমার মুখের দিকে চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, কেন? আমি ঢােক গিলে বসলাম। এই এমনি। আজ অ-নে-ক বড় চাঁদ উঠেছে তাে। অনেক আলাে আকাশে। কী ভেবে বাবা বললেন, চল। এরপর বাবা অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে তার নকল পা দুটো লাগালেন। কাঠের পা। হাতে লাঠি নিলেন। তারপর একটু একটু করে হেঁটে দোতলায় সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলেন। অনেকক্ষণ লাগল বাবার উঠতে। বাবার পেছন পেছন আমিও ছাদে উঠলাম। ছাদের উপর লম্বা লম্বা সিমেন্টের ঢালাই। একটা ঢালাইয়ের আবর্জনা পরিষ্কার করে আমি আর বাবা বসলাম। আমাদের মাথার উপরে চাঁদ তখন হাসছে। চাঁদের হাসি দেখে আমারও খুব হাসি পেল।

আমি হেসে বাবাকে বললাম, সুন্দর আলাে, তাই না বাবা? বাবা বললেন, সুন্দর। এরপর বাবা চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। আমাদের বাড়ির পাশে মন্টুদের বাড়ি। তার পাশে সত্যদের বাড়ি। তার পাশে মেরিনাদের বাড়ি। বাড়িগুলাের পরে লম্বা রাস্তা যত দূর চোখ যায় চলে গেছে। রাস্তার পাশেই খােলা মাঠ। রাতের বেলা একটু কুয়াশা জমে যেন সেটাকে তেপান্তরের মাঠ বলে মনে হচ্ছে। আমাদের বাড়ির সীমানার ভিতরে আম আর কাঁঠালের গাছ। গেটের পাশে সাদা ফুলে ভরা কামিনী গাছের ঝাড়। একটা কাঠবাদামের চারা ছাতার মতাে ডানা মেলে আছে উঠোনে। বাতাসে ফুলের মৃদু সুঘ্রাণ। বাবা চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখে বললেন, সুন্দর, আমাদের দেশটা সুন্দর। আমি চুপ করে থাকলাম। তখন বাবা হঠাৎ করে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, তাের খুব মন খারাপ করে, তাই না? আমি বাবার কথা শুনে হচকিয়ে গিয়ে বললাম, কেন? বাবা বললেন, আমাকে নিয়ে মানুষজনের সামনে তাের খুব লজ্জা হয়, না রে? 

আমি বললাম, কেন? বাবা বললেন, আমি যে তােকে কোথাও বেড়াতে নিতে পারি নে, হৈ চৈ করতে পারি নে, তােকে আনন্দ দিতে পারি নে, আমার যে পা নেই। বাবার কথা শুনে আমি থ’ হয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, একথা কেন বলছ বাবা? বাবা আমার দিকে ফিরে কেমন করে যেন হেসে বললেন, তাের সব বন্ধুর বাবার পা আছে। তাের নিশ্চয় মানুষের কাছে বলতে খারাপ লাগে যে, তাের বাবা পঙ্গু। তার দুটি পা-ই নেই। 

তুই যখন আরও বড় হবি, তুইও আমাকে ছেড়ে চলে যাবি। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি কোনােদিনও কারাে ঘাড়ে বােঝা হবাে না। বাবার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। আমার বয়স এখন ষােল। যখন আমি খুব ছােট্ট আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে যান, খুব বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন নয়টা মাস, দেশ স্বাধীন হবার মাত্র ক'সপ্তাহ আগে মাইন বিস্ফোরণে বাবা পা হারান। নিজেকে মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে গণ্য করে অত্যন্ত গর্ববােধ করেন আমার বাবা। সেই বাবার মুখে এই কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে বােধশক্তি ফিরে এলাে আমার। আমি বাবার পাশ ঘেঁষে বসলাম। বাবার মুখের দিকে তাকালাম। তাকিয়ে থেকে বললাম, আমাদের মতাে ছেলেদের পাগুলাে ঠিক রাখতে গিয়ে তুমি মুক্তিযুদ্ধে নিজের পা হারিয়েছিলে বাবা। তুমি নিজের পা অক্ষত রাখতে চাইলে আজ এই দেশে আমাদের মতাে ছেলেরা তাদের দুটো পা-ই হারাত। আমি তােমাকে ছেড়ে ৪ কোনােদিন যাব না বাবা। কক্ষনাে না। আমার কথা শুনে মনে হলাে বাবার কাঠের পাদুটো কেমন যেন থর থর করে কেঁপে উঠল। অবশ্য এটা আমার চোখের ভুলও হতে পারে। কাঠের পা কি কখনাে আবেগে কেঁপে উঠতে পারে?


লেখক-পরিচিতি আনােয়ারা সৈয়দ হক ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই নভেম্বর যশাের জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। তিনি পেশায় চিকিৎসক। মনােরােগ বিশেষজ্ঞ ও 
অধ্যাপক। তিনি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ: ছানার নানা 
৯৭৭), বাবার সঙ্গে ছানা (১৯৮৬), ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮৭) প্রভৃতি। তিনি অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য। পুরস্কার, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার এবং কবীর চৌধুরী শিশু সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। 

পাঠ পরিচিতি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত গল্প। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ দেশের মানুষ মরণপণ লড়াই করে বিজয়ী হয়। এই যুদ্ধে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দান করেন। অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধা যুদ্ধাহত হয়ে স্বাধীন দেশে জীবনযাপন করেন। এই গল্পের নায়ক একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা। যুদ্ধের শেষদিকে একটি অপারেশন আগে রেকি করতে গেলে মাইন বিস্ফোরণে তাঁর দুই পা হাঁটুর নিচ থেকে উড়ে যায়। চিকিৎসা করানাের পরে তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন। তাঁকে দুটো নকল পা লাগিয়ে দেওয়া হয়। একদিন যুদ্ধ শেষ হয়। স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন তিনি। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে শুরু করেন নতুন জীবন।। ছেলের যখন ষােল বছর বয়স তখন একদিন তার মনে হয় বড় হয়ে ছেলেটি ওর পঙ্গু বাবাকে ছেড়ে চলে যাবে নাতাে? মুক্তিযােদ্ধার ভীষণ মন খারাপ হয়। একদিন ছেলেকে এই কথা জিজ্ঞেস করতেই ছেলেটি হতভমন্ড হয়ে যায়। ও বাবার পাশে বসে বলে, বাবা তুমিতাে আমাদের মতাে ছেলেদের পা ঠিক রাখতে মুক্তিযুদ্ধে নিজের পা হারিয়েছিলে। তুমি তােমার পা অক্ষত রাখতে চাইলে আমাদের মতাে ছেলেরা তাদের পা হারাত বাবা। আমি তােমাকে ছেড়ে কোনদিন কোথাও যাব না। ছেলের কথা শুনে মুক্তিযােদ্ধা বাবা গভীর আবেগে কেঁপে উঠেন। 

সৃজনশীল প্রশ্ন কাজলের দাদা রহমান সাহেব হুইল চেয়ারে বসেই চলাফেরা করেন। দাদি কাজলকে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দাদাকে এমনভাবে মেরেছিল যে তিনি পঙ্গু হয়ে যান। দাদা তখন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কাজল দাদার কাছে জানতে চায়- “এ অবস্থার জন্য তােমার মনে কোনাে প্রতিক্রিয়া হয় না?” দাদা বলেন- “আমার মতাে এ রকম হাজারাে পঙ্গু মুক্তিযোেদ্ধার পায়ের উপর ভর করেই তাে দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন বাংলাদেশ।” 
ক. খালের ওপারে ক্যাম্প বসিয়েছিল কারা ? 
খ. নয়নের বাবাকে কাঠের পা বানিয়ে দেয়া হয়েছিল কেন? 
গ. কাজলের দাদার জীবনে কাঠের পা গল্পের প্রতিফলিত দিকটি ব্যাখ্যা কর। 
ঘ. কাজলের দাদার উক্তিটি কাঠের পা গল্পের আলােকে বিশ্লেষণ কর। 

Post a Comment

0 Comments