বালকের সততা -ডা. মােহাম্মদ লুৎফর রহমান


বড়বাজারে এক তাঁতির একখানা দোকান ছিল। একদিন দোকানে বেচাকেনা করার সময় একটা জরুরি কাজে করিম বখশ বলে এক ছেলেকে দোকানে বসিয়ে রেখে তিনি কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গেলেন। করিম বখ্শ এক ঘণ্টা দোকানে বসে থাকল,কিন্তু তবুও দোকানদার ফিরে এল না। এদিকে ক্রেতারা জিনিসপত্রের জন্য তাগাদা দিতে লাগল। করিম বখশের জিনিসপত্রের দাম জানা ছিল, সে কয়েকখানা কাপড় বিক্রি করল। দুঃখের বিষয় সারা দিন চলে গেল তবুও দোকানদার ফিরে এলাে না। করিম অগত্যা সেদিন আর বাড়ি ফিরতে পারল না। দোকানদারের অপেক্ষায় সেখানেই রাত্রি যাপন করল। পরের দিন যথাসময়ে দোকান খুলে করিম মালিকের অপেক্ষা করতে লাগল, কিন্তু মালিকের সন্ধান নেই। করিম অগত্যা নিজেই দোকানে বেচাকেনা করতে লাগল। এভাবে দুদিন, তিনদিন, শেষে এক মাস কেটে গেল। আঁতি ফিরল না। করিম দোকানের ভার ফেলে যাওয়া ০ অধর্ম মনে করে বিশ্বস্ত ভৃত্যের মতাে কাজ চালাতে লাগল। তাঁতি যাদের কাছে ঋণী ছিল, করিম তাদের সব বালকের সততা 

টাকা পরিশােধ করল। তাঁতির হয়েই সে নতুন কাপড়ের চালান এনে দোকানের আয় ঠিক রাখল। এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। করিমের আন্তরিক চেষ্টায় দোকানের ক্রমেই উন্নতি হচ্ছিল। শেষে এক দোকানের পরিবর্তে তিনটি দোকান স্থাপিত হলাে।করিম সব দোকান তাতির নামে চালাতে লাগলাে। লােকেরা ভাবল, করিম তাঁতির দোকান কিনে নিয়েছে। করিমের সম্মান-প্রতিপত্তি ইত্যবসরে খুব বেড়ে গেল। 

সে মত সওদাগর হয়ে বিরাট কারবার চালাতে লাগল। প্রায় সাত বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। একদিন করিম দোকানের গদিতে বসে আছে। একজন বুড়াে লাঠি ভর করে তারই দোকানের সামনে করিম বলে একটা বালকের খোঁজ করছে। বুড়াের পরনে একখানা ময়লা কাপড়, রােগা চেহারা, শরীর একেবারে ভেঙে গিয়েছে। তাকে পথের ভিক্ষুক বলে মনে হচ্ছিল। করিম দৌড়ে এসে বুড়ােকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে বলল, “আমি হচ্ছি সেই করিম, এই সাত বছর আমি আপনার দোকান পাহারা দিয়েছি। দয়া করে এখন আপনি আপনার দোকানের ভার নিন, আমি বিদায় হই।” করিমের মহত্মাণের পরিচয় পেয়ে বৃদ্ধের দুচোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। বললেন- আমার আর কিছু দরকার নেই, এ সবই তােমার। আমার এ সংসারে যারা আপন ছিল, সবাই আমাকে ছেড়ে গেছে।

 এখন তুমিই আমার আপন। সেই সাত বছর আগের কথা, এখান থেকে বেরিয়ে পথে সংবাদ পেলাম আমার পত্নীর সাংঘাতিক পীড়া। কালবিলম্ব না করে আমাকে বাড়ি যেতে হয়েছিল। গিয়ে দেখলাম পত্নীর মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যুর কয়েকদিন পরে ছেলে দুটো মারা গেল। তারপর নানা দুর্বিপাকে পড়ে আমি কিছুতেই বাড়ি ত্যাগ করতে পারলাম না। তারপর এই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। এখন আমার কেউ নেই। আত্মীয়-স্বজন, অর্থ, দেহের বল সব হারিয়ে এখন আমি পথের ফকির হয়েছি। অতি দুঃখে অনেক আশা নিরাশায় মনে হলাে দোকানে গিয়ে একবার করিমের সন্ধান করি, তাকে যদি পাই তার কাছ থেকে দু-এক টাকা ভিক্ষে নেব। দোকান কি আর এতদিন আছে? করিম, আমি তােমাকে এমন রাজার হালে দেখব এ কখনাে মনে করিনি। আর তুমি যে এমন করে আমার কাছে পরিচয় দিলে এ ভেবে আমার মনে যে কী আনন্দ হচ্ছে তা আর কী বলব। বললা বাবা, তুমি মানুষ না ফেরেশতা! | করিম সবিনয়ে বলল, আপনি আমার পিতার মতাে আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন, সে বিশ্বাসকে আমি রক্ষা করতে পেরেছি এই আমার পক্ষে ঢের। এর বেশি আমি কিছু আশা করিনি। তাঁতি করিমের হাত থেকে দোকানের ভার গ্রহণ করলেন না। জীবনে তার আর বন্ধন রইল না। একটা মাসিক বন্দোবস্ত করে তিনি অতঃপর তীর্থে চলে গেলেন। 

লেখক-পরিচিতি ডা. মােহাম্মদ লুত্যর রহমান ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মাগুরা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। লেখাপড়া শেষ করে প্রথম জীবনে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরে ডাক্তারি (হােমিওপ্যাথি) পেশা গ্রহণ করেন। তিনি অনেক উপদেশমূলক প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে এই সৃষ্টিশীল প্রাবন্ধিক মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি হচ্ছে- ‘উন্নতজীবন', 'মহজ্জীবন’, ‘মানবজীবন', 3 ‘ধর্মজীবন’, ‘প্রীতিউপহার।

সারসংক্ষেপ এক আঁতির একটি কাপড়ের দোকান ছিল। একদিন জরুরি কাজে তিনি দোকানের বাইরে গেলেন, দোকানের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন করিম বখশ নামের এক ছেলেকে। নানা দুর্বিপাকে পড়ে দোকানি দীর্ঘদিন ফিরে আসতে পারলেন না। করিম সততার সাথে কাজ করে দোকানের অনেক উন্নতি করল। ক্রমে এক দোকানের পরিবর্তে তিনটি দোকান স্থাপিত হলাে। প্রায় সাত বছর পরে হঠাৎ দোকানি ফিরে এলেন। করিম সাদরে তাকে বরণ করে দোকানের দায়িত্ব তার হাতে তুলে দিতে আগ্রহী হলাে। করিমের মহৎ প্রাণের পরিচয় পেয়ে বৃদ্ধ দোকানি অভিভূত হলেন। নিজের জন্য একটা মাসিক বন্দোবস্ত করে, করিমের হাতেই দোকান বুঝিয়ে দিয়ে তিনি তীর্থে চলে গেলেন। বালক তার সততার পুরস্কার পেল। 

শব্দার্থ ও টীকা অগত্যা – বাধ্য হয়ে। বিশ্বস্ত – বিশ্বাসের পাত্র, বিশ্বাসযােগ্য। ইত্যবসরে – এ সময়ের মধ্যে, ইতােমধ্যে। বিলম্ব—দেরি। দুর্বিপাক–দুর্যোগ। অতিবাহিত -পার করা। সন্ধান খোঁজ। বন্দোবস্ত ব্যবস্থা। অতঃপর -তারপর। প্রতিপত্তি-প্রতিষ্ঠা, সম্মান। তীর্থ – পুণ্যস্থান

সৃজনশীল প্রশ্ন - চার সন্তানের জননী রহিমা বেগমের অভাবের সংসার। বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী সে। একদিন রেলের বগি পরিষ্কার করতে গিয়ে একটি ব্যাগ খুঁজে পায়। ব্যাগে ছিল অনেক টাকা। ভালাে করে খুঁজতেই ওটার মধ্যেই পেল মালিকের ফোন নম্বর। পরে মালিককে ডেকে সে সব টাকা ফেরত দিল। মালিক খুশি হয়ে তাকে বকশিস দিতে চাইলে সে তা গ্রহণ করতে রাজি হলাে । পরে অনেক বুঝিয়ে মালিক রহিমাকে রাজি করাতে সক্ষম হলাে। 
ক. কত বছর পর করিমের মালিক ফিরে এলাে? 
খ. ‘বললা বাবা, তুমি মানুষ না ফেরেশতা!' বৃদ্ধের এমন উক্তির কারণ বুঝিয়ে লেখ। 
গ. উদ্দীপকের রহিমা বেগমের কোন গুণটি ‘বালকের সততা’ গল্পের করিম বখ্শ এর মধ্যে পাওয়া যায়? ব্যাখ্যা কর। 
ঘ. ‘পরিণতির দিক থেকে গল্পটির সাথে উদ্দীপকের কোনাে মিল নেই।'-মন্তব্যটি সম্পর্কে তােমার মত দাও। 

Post a Comment

0 Comments