চিন্তাশীল -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


প্রথম দৃশ্য
চিন্তাশীল নরহরি চিন্তায় নিমগ্ন। ভাত শুকাইতেছে 
মা মাছি তাড়াইতেছেন 
মা। অত ভেবাে না, মাথার ব্যামাে হবে বাছা! 
নরহরি। আচ্ছা মা, বাছা' শব্দের ধাতু কী বলাে দেখি। 
মা। কী জানি বাপু!

নরহরি। বস'। আজ তুমি বলছ বাছা’-দু হাজার বৎসর আগে বলত ‘বস’-এই কথাটা একবার ভালাে করে ভেবে দেখাে দেখি মা! কথাটা বড় সামান্য নয়। এ কথা যতই ভাববে ততই ভাবনার শেষ হবে না। 
পুনরায় চিন্তায় মগ্ন 
মা। যে ভাবনা শেষ হয় না এমন ভাবনার দরকার কী বাপ! ভাবনা তাে তাের চিরকাল থাকবে, ভাত যে ও শুকোয়। লক্ষ্মী আমার, একবার ওঠ।

নরহরি। (চমকিয়া) কী বললে মা? লক্ষ্মী? কী আশ্চর্য! এক কালে লক্ষ্মী বলতে দেবী-বিশেষকে বােঝাত। পরে লক্ষ্মীর গুণ অনুসারে সুশীলা স্ত্রীলােককে লক্ষ্মী বলত, কালক্রমে দেখাে পুরুষের প্রতিও লক্ষ্মী শব্দের প্রয়ােগ হচ্ছে। একবার ভেবে দেখাে মা, আস্তে আসেত ভাষার কেমন পরিবর্তন হয়! ভাবলে আশ্চর্য হতে হবে। 

ভাবনার দ্বিতীয় ডুব 
মা। আমার আর কি কোনাে ভাবনা নেই নরু? আচ্ছা, তুই তাে এত ভাবিস, তুইই বল্ দেখি, উপস্থিত কাজ উপস্থিত ভাবনা ছেড়ে কি এই-সব বাজে ভাবনা নিয়ে থাকা ভালাে? সকল ভাবনারই তাে সময় আছে। 

নরহরি। এ কথাটা বড় গুরুতর মা! আমি হঠাৎ এর উত্তর দিতে পারব না। এটা কিছুদিন ভাবতে হবে—ভেবে পরে বলব। 

মা। আমি যে কথাই বলি তাের ভাবনা তাতে কেবল বেড়েই উঠে, কিছুতেই আর কমে না। কাজ নেই বাপু, আমি আর কাউকে পাঠিয়ে দিই। 

[প্রস্থান] মাসিমা 
মাসিমা। ছি নরু, তুই কি পাগল হলি? হেঁড়া চাদর, একমুখ দাড়ি। সমুখে ভাত নিয়ে ভাবনা! সুবলের মা তােকে দেখে হেসেই কুরুক্ষেত্র! 

নরহরি। কুরুক্ষেত্র! 
আমাদের আর্যগৌরবের শ্মশানক্ষেত্র! মনে পড়লে কি শরীর রােমাঞ্চিত হয় না? অন্তঃকরণ অধীর হয়ে উঠে না? আহা, কত কথা মনেপড়ে! কত ভাবনাই জেগে উঠে! বলাে কী মাসি! হেসেই কুরুক্ষেত্র! তার চেয়ে বলােনা কেন কেঁদেই কুরুক্ষেত্র? 

অশুনিপাত 
মাসিমা। ওমা, এ যে কাঁদতে বসল! আমাদের কথা শুনলেই এর শােক উপস্থিত হয়। কাজ নেই বাপু! 

প্রস্থান] দিদিমা 
দিদিমা। ও নরু, সূর্য যে অত যায়। নরহরি। ছি দিদিমা, সূর্য তাে অত যায় না। পৃথিবীই উল্টে যায়। রােসাে, আমি তােমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। 

চারদিকে চাহিয়া একটা গােল জিনিস কোথাও নেই? 
     দিদিমা। এই তােমার মাথা আছে- মুণ্ডু আছে।
     নরহরি। কিন্তু মাথা যে বন্ধ, মাথা যে ঘােরে না। 
     দিদিমা। তােমারই ঘােরে না, তােমার রকম দেখে পাড়াসুদ্ধ লােকের মাথা ঘুরছে! নাও, আর তােমায় বােঝাতে হবে না, এ দিকে ভাত জুড়িয়ে গেল, মাছি ভন্ ভন্ করছে। 

    নরহরি। ছি দিদিমা, এটা যে তুমি উল্টো কথা বললে; মাছি তাে ভন্ ভন্ করে না। মাছির ডানা থেকেই এইরকম শব্দ হয়। রােসাে, আমি তােমাকে প্রমাণ করে দিচ্ছি -
     দিদিমা। কাজ নেই তােমার প্রমাণ করে। 


দ্বিতীয় দৃশ্য 
নরহরির চিন্তামগ্ন ভাবনা ভাঙাইবার উদ্দেশ্যে 
নরহরির শিশু ভাগিনেয়কে কোলে করিয়া মাতার প্রবেশ 
     মা। (শিশুর প্রতি) জাদু, তােমার মামাকে দণ্ডবৎ কর। 

    নরহরি। ছি মা, ওকে ভুল শিখিয়াে না। একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে, ব্যাকরণ অনুসারে দণ্ডবৎ করা হতেই পারে না- দণ্ডবৎ হওয়া বলে। কেন বুঝতে পেরেছ মা? কেননা দণ্ডবৎ মানে-

     মা। না বাবা, আমাকে পরে বুঝিয়ে দিলেই হবে। তােমার ভাগ্নেকে এখন একটু আদর কর । 
     নরহরি। আদর করব! আচ্ছা এসাে, আদর করি। 
শিশুকে কোলে লইয়া 
কী করে আদর আরমভ করি? রােসাে, একটু ভাবি। 

চিন্তামগ্ন 
      মা। আদর করবি, তাতেও ভাবতে হবে নরু? 
     নরহরি। ভাবতে হবে না মা?বলােকী? ছেলেবেলাকার আদরের উপরে ছেলের সমস্ত ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তা কি জান? ছেলেবেলাকার এক-একটা সামান্য ঘটনার ছায়া বৃহৎ আকার ধরে আমাদের সমস্ত যৌবনকালকে, আমাদের সমস্ত জীবনকে আচ্ছন্ন করে রাখে, এটা যখন ভেবে দেখা যায় তখন কি ছেলেকে আদর করা একটা সামান্য কাজ বলে মনে করা যায়? এইটে একবার ভেবে দেখাে দিকি মা! 

     মা। থাক্ বাবা, সে কথা আর-একটু পরে ভাবব, এখন তােমার ভাগ্নেটির সঙ্গে দুটো কথা কও দেখি। 
নরহরি। ওদের সঙ্গে এমন কথা কওয়া উচিত যাতে ওদের আমােদ ও শিক্ষা দুই হয়। আচ্ছা হরিদাস, তােমার নামের সমাস কী বলাে দেখি? 
     হরিদাস। আমি চমা কাব। 

     মা। দেখাে দেখি বাছা, ওকে এ-সব কথা জিগেস কর কেন? ও কী জানে! 
     নরহরি। না, ওকে এই বেলা থেকে এইরকম করে অল্প অল্প মুখস্থ করিয়ে দেব। 
     মা। (ছেলে তুলিয়া লইয়া) না বাবা, কাজ নেই তােমার আদর করে। 
নরহরি মাথায় হাত দিয়া পুনশ্চ চিন্তায় মগ্ন। 

     মা। (কাতর হইয়া) বাবা, আমায় কাশী পাঠিয়ে দে, আমি কাশীবাসী হবাে। 
     নরহরি। তা যাও-না মা! তােমার ইচ্ছে হয়েছে, আমি বাধা দেব না। মা। (স্বগত) নরু আমার সকল কথাতেই ভেবে অস্থির হয়ে পড়ে, এটাতে বড় বেশি ভাবতে হলাে না।

     (প্রকাশ্যে)তা হলে তাে আমাকে মাসে মাসে কিছু টাকার বন্দোবস্ত করে দিতে হবে। 
     নরহরি। সত্যি নাকি? তা হলে আমাকে আর কিছু দিন ধরে ভাবতে হয়। এ কথা নিতান্ত সহজ নয়। আমি এক হপ্তা ভেবে পরে বলব। 
     মা। (ব্যত হইয়া) না বাবা, তােমার আর ভাবতে হবে না। আমার কাশী গিয়ে কাজ নেই। 

লেখক-পরিচিতি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে, (৭ই মে, ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে) কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অল্প বয়সে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে ও ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। ১৯১৩ সালে তিনি তাঁর ‘গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার ‘নােবেল প্রাইজ লাভ করেন। এশীয়দের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম এ পুরস্কার লাভ করেন। একমাত্র মহাকাব্য ছাড়া তিনি সাহিত্যের সব শাখাতেই বিচরণ করেছেন। ২২ শে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে (৭ই আগস্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে) কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 


সারসংক্ষেপ -এই চিন্তাধর্মী নাটিকাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি হাস্যরসাত্মক রচনা। কথায় আছে-“ভাবিয়া করিও কাজ” কিন্তু বেশি বেশি কোনাে কিছুই ভালাে নয়। তেমনি বেশি ভাবাও মঙ্গলজনক নয়। নরহরি সব সময় চিন্তায় মগ্ন থাকে, সে জন্য লেখক তাকে চিন্তাশীল বলেছেন। বেশি চিন্তা করার ফলে সে বাস্তব জগৎ থেকে দূরে সরে আছে, সাথে সাথে তার আশপাশের মানুষদেরকেও বিব্রত করছে। নরহরির মতাে যারা অকারণে সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করে করে সময় নষ্ট করে, তাদের দিয়ে বাস্তবে কোনাে কাজই হয় না। তবে কোনাে সময়ই কোনাে কিছু নিয়ে চিন্তা করব না, এমনটাও ঠিক নয়।

শব্দার্থ ও টীকা : চিন্তাশীল-চিন্তাপরায়ণ, চিন্তা দ্বারা বিচার করতে সমর্থ। বৎস-বাছা, স্নেহ সম্বােধনে। বাচ্চা, শাবক, বাছুর। উপস্থিত-বর্তমান, বিদ্যমান, হাজির, নিকটস্থ, সম্মুখবর্তী। কুরুক্ষেত্ৰ-কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধক্ষেত্র (মহাভারতে বর্ণিত) (কুরু-চন্দ্রবংশীয় রাজাবিশেষ, কৌরব)। রােমাঞ্চিত- অতিরিক্ত আনন্দ, পুলক, ভয়, বিস্ময়ের কারণে গায়ের লােম খাড়া হওয়া, গায়ে কাঁটা দেওয়া। অন্তঃকরণ-মন, হৃদয়। অধীর-চঞ্চল, অস্থির, কাতর, ব্যাকুল, অসহিষ্ণু। দণ্ডবৎ-(মূল অর্থ দণ্ডের তুল্য) প্রণাম করার জন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়া। রােসাে - সবুর কর। আচছন - আবৃত, ঢাকা, ব্যাপ্ত, অচৈতন্য, অভিভূত। পুনশ্চ-আবারও, পুনরপি (লেখা শেষ করে আবার কিছু লিখতে হলে পুনশ্চ দিয়ে আরমভ করতে হয়)। কাশী-হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান, বারানসী, বেনারস। কাশীবাসী-কাশীধামে তীর্থবাসকারী। স্বগত-আত্মগত, মনে মনে, যা কোনাে ব্যক্তিকে উদ্দেশ না করে আপন মনে বলা হয়। শ্মশান-যেখানে মৃত ব্যক্তিকে পােড়ানাে হয়, শবদাহস্থান।

সৃজনশীল প্রশ্ন -নন্দ বাড়ির হত না বাহির, কোথা কী ঘটে কি জানি, চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি। নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে কলিশন হয়, হাঁটিলে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়।। তাই শুয়ে শুয়ে কষ্টে বাঁচিয়া রহিল নন্দলাল, সকলে বলিল, ‘ভ্যালারে নন্দ বেঁচে থাক চিরকাল।
ক. ‘চিন্তাশীল’ নাটিকার লেখকের নাম কী? 
খ. ‘আমি কাশিবাসী হবাে।'- উক্তিটি দ্বারা কী বুঝানাে হয়েছে? 
গ. যে দিক থেকে উদ্দীপকের নন্দের সাথে ‘চিন্তাশীল’ নাটিকার নরহরির সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় তা ব্যাখ্যা কর। 
ঘ. ‘শিশুদের সম্পর্কে নরহরির ভাবনা উদ্দীপকে অনুপস্থিত’ কথাটি ব্যাখ্যা কর। 

Post a Comment

0 Comments