অপেক্ষা -সেলিনা হােসেন


রুমা আর রুবা দুই বােন। ওদের খুব ভাব। একসঙ্গে স্কুলে যায়। একসঙ্গে খেলে। খুব কমই ঝগড়া হয় ওদের। রুমার বয়স বারাে আর রুবার দশ। দুই জনের জন্মদিন নিয়ে ওদের মা-বাবার এক একটি গল্প আছে। ওদের মা রাহেলা বলে, যেদিন রুমার জন্ম হয় সেদিন বাড়ির উঠোনের শিউলি গাছটা ফুলে ফুলে ভরে ছিল। এত ফুল নাকি আর কখনাে দেখে নি রাহেলা বানু। খুশবু ছড়িয়ে গিয়েছিল চারদিকে। রুবা উদগ্রীব হয়ে বলে, মা আমার গল্পটা বল। তাের গল্পটা আমি বলব, । এ কথা বলে জসীম মিয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। বলে, যেদিন তুই হলি সেদিন বাড়ির বাইরের আমগাছটার নিচে বসে আছি। হঠাৎ মাথার ওপরে তাকিয়ে দেখি আমের বােলে ভরে আছে গাছটা। এত বােল আসতে দেখি নি আগে। বােলের গন্ধে চারদিক ভরে গেছে। 

দুই বােন মা-বাবার আদরের ছায়ায় বড় হয়। স্কুলে যাওয়ার পথে বুনােফুল ছিড়ে বেণীর সঙ্গে গেঁথে রাখে। ফড়িং ধরে। আবার আকাশে উড়িয়ে দেয়। ফুলের পাপড়ি ছিড়ে খাতার ভিতর চাপা দিয়ে রাখে। শুকিয়ে গেলে বাবার কপালে লাগিয়ে দিয়ে বলে, বাবা তােমার হাজার বছর আয়ু হােক। মায়ের কপালে লাগিয়ে দিয়ে বলে, মা তােমার ভাতের হাঁড়ি ভরা থাকুক। জসীম মিয়া ওদের কপালে চুমু দিয়ে বলে, আমার মেয়েগুলাের অনেক বুদ্ধি। অনেক বড় হ, মা। চাইলে লেখাপড়ার জন্য তােদের আমি ঢাকা পাঠাব। দুই বােন খুশিতে হাততালি দেয়। মা-বাবা ওদের উস্ফুল্ল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একদিন জসীম মিয়া বাজারে যায়। সেখান থেকে দুই সের চাল-ডাল কিনে বাড়ি ফিরে বারান্দায় ধপাস করে বসে পড়ে। ছুটে আসে রাহেলা বানু। 
– কী হয়েছে? 
– যুদ্ধ। 
- যুদ্ধ? রাহেলা বানু অবাক হয়ে বলে। 

কিছু বলার আগেই জসীম শুনতে পায় বাইরে হইচই। ও দুই মেয়ের হাত ধরে বাইরে আসে। দেখে লােকজন আমগাছের নিচে গােল হয়ে বসে রেডিওতে খবর শুনছে। বিবিসির খবরে বলছে, ঢাকা শহরে গত মধ্যরাতে গণহত্যা শুরু করেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। 
জসীমের মনে পড়ে কিছুদিন আগে ওরা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনছিল-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। 

লােকজন খবর শুনে উত্তেজিত হয়ে বলে, আমাদের সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে। রুমা-রুবা বাবার হাত ছাড়িয়ে অন্য ছেলেমেয়েদের কাছে যুদ্ধের কথা বলার জন্য ছুট দেয়। চিৎকার করে বলে, যুদ্ধ করতে হবে রে। যুদ্ধ যুদ্ধ। কয়েকমাস পরে গায়ে মিলিটারি আসে। জসীম শহর থেকে আসা ছেলেদের কাছ থেকে রাইফেল চালানাে শিখে নেয়। তারপর গড়ে তােলে মুক্তিবাহিনী। রাহেলা মেয়েদের নিয়ে বাড়িতে থাকবে। জসীম চেয়েছিল রাহেলা ওর বাবার বাড়ি চলে যাক, কিন্তু রাহেলা যেতে রাজি হয় নি।

নদীর ধারেই বাজার। সেদিন বিকেলে বাজারে গেলে পাকিস্তানি মিলিটারির সামনে পড়ে যায় জসীম। ওরা বাজারের দোকান ও ঘর-বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসে। একটি বুলেট এসে লাগে জসীমের বুকে। নদীর ধারে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ও। রক্তে ভেসে যায় মাটি। নিজেরই রক্তে মাখামাখি হয়ে যায় ওর শরীর। মিলিটারিরা চলে গেলে যারা পালিয়ে গিয়েছিল তারা ঘরে ফিরে আসে। রাহেলাও মেয়েদের নিয়ে আসে বাড়িতে। অনেক বাড়ি পুড়ে গেলেও ওদের বাড়িতে আগুন লাগে নি। বড় আমগাছটা ঘরের চাল আড়াল করে রেখেছে বলে আগুন এখানে আসতে পারে নি। রাহেলা সারা রাত জসীমের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু জসীম বাড়ি ফেরে না। রুমা-রুবা কাদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়। পরদিন গাঁয়ের লােকেরা জসীমের লাশ নিয়ে আসে বাড়িতে।

 রুমা-রুবা কিছুক্ষণ বাবাকে দেখে নিচ্ছুপ হয়ে যায়। যেন ওরা কথা বলা ভুলে গেছে। রাহেলা তাে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে। গাঁয়ের মেয়েরা ওদের মাকে দেখাশােনা করছে। দুই বােন রান্নাঘরের দরজায় চুপ করে বসে থাকে। রুবারুমার হাত ধরে কঁকিয়ে বলে, যুদ্ধ মানে কী বুবু? রুমা দুই হাতে চোখ মুছে বলে, বাবার মরে যাওয়া। দুই জন আকাশের দিকে তাকায়। অনেক দূরে কালাে ধোঁয়ার মতাে কিছু একটা আকাশের দিকে উঠছে। উঠছে তাে উঠছেই। ওরা বুঝতে পারে পাশের গ্রামে আগুন দিয়েছে পাকিস্তানি মিলিটারি। দুই বােন আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। দুই জনেই বুঝতে পারে যুদ্ধ মানে কী! ঘাের বর্ষা। বৃষ্টির তােড়ে ডুবে যায় মাঠঘাট। রাহেলা বানু শুকনাে মুখে বারান্দায় বসে থাকে। দুই বােন ধানখেতের আলের পাশ দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া পানি থেকে কুঁচো চিংড়ি ধরে আনে। ওদের মা অন্যের বাড়ি থেকে আনা চালে ভাত রান্না করে। দু-মুঠো চাল মাটির কলসিতে জমিয়ে রাখে রাহেলা বানু। রাতে কোনাে মুক্তিযােদ্ধা এলে তার জন্য ভাত রান্না করবে। দুই বােন শুকনাে লাকড়ি কুড়িয়ে এনে রান্নাঘরে জমিয়ে রাখে। যদি লাকড়ির দরকার হয় তখন কী দিয়ে ভাত রান্না করবে মা? দুই বােন অধীর অপেক্ষায় থাকে। সে রাতে বৃষ্টি ছিল না। জ্যোৎস্নায় ভরা ছিল উঠোন। 

গভীর রাতে দুইজন মুক্তিযােদ্ধা আসে ওদের বাড়িতে। চুপিচুপি ডাকে, মা দরজা খােল মাগাে রুবা ধড়মড়িয়ে উঠে রুমাকে ডাকে। ও ঠেলে মাকে জাগায়। –মা ওঠো। শােন, কেউ এসেছে। রাহেলা বানু দরজায় টুকটুক শব্দ শােনে। দরজার কাছে গেলে আবার শুনতে পায় সে ডাক, মা দরজা খােল। রাহেলা কঁপা হাতে দরজা খুললে দুইজন মুক্তিযােদ্ধা দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ওদের একজন বলে, ট্রেনিংয়ের সময় জসীম কাকু আমাদের বলেছিলেন দরকার হলে যেন আপনার কাছে আসি। 

– মা, আপনি আমাদের চিনবেন না। আমাদের খিদে পেয়েছে। ভাত খেয়েই চলে যাব। 
– কোথায় যাবে? রুমা জিজ্ঞেস করে। - নদীর ওপারে। ওখানে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প আছে। 
– তােমরা যুদ্ধ করবে? রুবা জানতে চায়। - হ্যা, আমরা পাকিস্তানি মিলিটারির ক্যাম্প আক্রমণ করব। – তােমাদের রাইফেলগুলাে ছুঁয়ে দেখি? 

রুমা গভীর আবেগে বলে। -হ্যা, দেখ। দুজনে দুবােনের কোলে রাইফেল দুটো দিয়ে দেয়। রাইফেল দুটো ওরা কোলে নিয়ে বসে থাকে। মা রান্না চড়ায়। কিছুক্ষণ পর রাহেলা গরম ভাত নিয়ে আসে গামলা ভরে। সঙ্গে ডিম-আলুর তরকারি। যােদ্ধা দুইজন গপগপিয়ে খায়। দেরি করার সময় নেই। নদীর ঘাটে ওদের জন্য নৌকা নিয়ে বসে আছে অন্যরা। দেরি করা চলবে না। খাওয়া শেষ হলে রাহেলা বলে, তােমরা আবার আসবে তাে? দরকার হলে আসতে পারি। নইলে অন্যেরা আসবে। কেউ না কেউ আসবে। রাহেলা বানুকে সালাম করে দুই বােনের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায় মুক্তিযােদ্ধারা।

বর্ষা শেষ।
আশ্বিনের শিউলি ফোটার দিন শুরু হয়েছে। একদিন দরজায় টুকটুক শব্দ হয়।
-খুকুমণিরা দরজা খােল।

দুই বােন লাফ দিয়ে উঠে দরজা খােলে। মুক্তিযােদ্ধারা আসে। ভাত খায়। নয়তাে একটু ঘুমিয়ে নেয়। রাতের অন্ধকারে আবার চলে যায়। ঘােরতর যুদ্ধ চলছে চারদিকে। রুমা আর রুবা রাতে ঠিকমতাে ঘুমাতে পারে না। ওরা আবার অপেক্ষা করে একটি ডাক শােনার জন্য,
– খুকুমণিরা দরজা খােল, আমরা মুক্তিযােদ্ধা।


প্রশ্নগুলাের উত্তর মুখে বলি ও লিখি। 
ক. রুমার জন্মদিনের গল্পটি কী?
খ. রুবার জন্মদিনের গল্পটি কী?
গ. রাহেলাবানু প্রতিদিন দুই মুঠো চাল উঠিয়ে রেখে দিত কেন?
ঘ. গভীর রাত পর্যন্ত দুই বােন কেন জেগে থাকত?
ঙ. মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে জসীম মিয়ার পরিবারের সম্পর্কটি ব্যাখ্যা কর।
চ. “আমার মেয়েগুলাের অনেক বুদ্ধি। অনেক বড় হ মা।”- “অনেক বুদ্ধি” এবং “বড় হ” বলতে তুমি কী বােঝ?
ছ, একজন মুক্তিযােদ্ধার যুদ্ধ করার জন্য কী কী যােগ্যতা ও দক্ষতা থাকা দরকার?


লেখক-পরিচিতি সেলিনা হােসেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক ও ছােটগল্পকার। | তিনি ১৪ই জুন ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা একাডেমিতে পরিচালক পদে থাকা অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন। “সাগর’, ‘গল্পে বর্ণমালা’, ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘চাদের বুড়ির পান্তা ইলিশ’ ইত্যাদি তাঁর লেখা শিশু-কিশাের উপযােগী বই। তিনি সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেলিনা হােসেন। পান। ২০০৯ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ২০১০ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা থেকে তিনি ডিলিট উপাধি পান। ২০১১ সালে দিল্লির সাহিত্য একাডেমি থেকে প্রেমচাঁদ ফেলােশিপ পান।

Post a Comment

0 Comments