তেতে, ভিতু, তিতুমীর। শুনতে বেশ অবাক লাগছে, তাই না? তা হলে খুলেই বলি। ১৭৮২ সাল। পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলা। সে জেলার বশিরহাট মহকুমায় একটি গ্রাম চাঁদপুর (মতাঞ্চল্লে হায়দারপুর)। এ গ্রামে বাস করত এক বনিয়াদি মুসলিম পরিবরি। সৈয়দ বংশ। এই বংশে জন্ম নেয় এক শিশু। ছােট্ট শিশুটি ছিল যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি বলিষ্ঠ তার গন। শিশুটি ছিল খুব জেদি। শিশুকালে তার একবার কঠিন অসুখ হলাে। ব্লোগ সারানোর জন্য তাকে দেওয়া হলাে জীষণ তেতে ওষুধ। এমন তেতাে ওষুধ শিশু তাে দূরের কথা বুড়ােরাও মুখে নেবে না। অথচ এই ছােট্ট শিশু বেশ খুশিতেই খেল সে ওষুধ। প্রায় দশ-বারােদিন এই তেতে ওষুধ খেল সে। বাড়ির লােকজন বাই অবাক।
এ কেমন শিশু, ভেঙ্গে যেতে তার আনন্দ। এ জন্যে ওর ডাক নাম রাখা হলাে তেতাে। তেতো থেকে তিতু। তার সাথে মীর লাগিয়ে হলাে তিতুমীর। তাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। তিতুমীরের যখন জন্ম, তখন আমাদের বাংলাদেশসহ পুরাে ভারতবর্ষ ছিল পরাধীন। চলছে ব্রিটিশ রাজত্ব। ইংরেজরা চালাত অত্যাচার। অন্যদিকে হিল দেশি জমিয়দের জুলুম। ইংরেজ কর্মচারীরা ঘােড়া গুটিয়ে চলন্ত দারুণ দাম্পটে। তিতুমীর এসব দেখতেন আর ভাবতে, এদের হাত থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে দেশের মানুষ।
তিতুমীরের গ্রামে ছিল একটি মাদরাসা। সেখানে শিক্ষক হিসেবে এলেন ধর্মপ্রাণ এক হাফেজ। নাম হাফেজ নেয়ামত উল্লাহ। তিতুমীর এ মাদরাসায় পড়তেন। তিনি অল্প সময়েই হাফেজ নেয়ামত উল্লাহর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন।
সেকালে গ্রামে গ্রামে ডনকুস্তি আর শরীরচর্চার ব্যায়াম হতাে। শেখানাে হতাে মুষ্টিযুদ্ধ, লাঠিখেলা, তীর ছোড়া আর অসিচালনা। উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ তাড়ানাের জন্য গায়ে শক্তি সঞ্চয় করা। তিনি ডনকুস্তি শিখে কুস্তিগির ও পালােয়ান হিসেবে নাম করলেন। লাঠিখেলা, তীর ছোড়া আর অসি পরিচালনাও শিখলেন। তাঁর অনেক ভক্তও জুটে গেল। তিতুমীরের গায়ে শক্তি ছিল প্রচুর। কিন্তু তিনি ছিলেন শান্ত ও ধীর স্বভাবের।
একবার ওস্তাদের সঙ্গে তিনি বিহার সফরে বেরােলেন। মানুষের দুরবস্থা দেখে তার মনে দেশকে স্বাধীন করবার চিন্তা এলাে। তিনি মুসলমানদের সত্যিকার মুসলমান হতে আহ্বান জানালেন। আর হিন্দুদের বললেন অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। হিন্দু-মুসলমান সকলে তাঁর কথায় সাড়া দিলেন।
১৮২২ সাল। তিতুমীরের বয়স তখন চল্লিশ। তিনি হজ পালন করতে গেলেন মক্কায়। সেখানে পরিচয় হলাে ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হযরত শাহ সৈয়দ আহমদ বেরলভীর সঙ্গে। তিনি ছিলেন সংগ্রামী পুরুষ এবং ধর্মপ্রাণ। তিতুমীর তাঁর শিষ্য হলেন। দেশে ফিরে তিনি স্বাধীনতার ডাক দিলেন। ডাক দিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে, নীলকরদের রুখতে আর নিজেদের সংগঠিত হতে। কিন্তু প্রথম বাধা পেলেন জমিদারদের কাছ থেকে। তার ওপর অত্যাচার শুরু হলাে। নিজ গ্রাম ছেড়ে তিনি গেলেন বারাসাতের নারকেলবাড়িয়ায়। নারকেলবাড়িয়ার লােকজন তাকে সাদরে গ্রহণ করলাে। হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তৈরি করলেন এক দুর্ভেদ্য বাঁশের দুর্গ।
এটাই নারকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লা। তাঁর এ কেল্লায় সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল চার-পাঁচ হাজার। চব্বিশ পরগনা, নদীয়া আর ফরিদপুর জেলা তখন তাঁর দখলে। ইংরেজদের কোনাে কর্তৃত্ব রইল না এসব অঞ্চলে। এ দুর্গে তিনি তাঁর শিষ্যদের লড়াইয়ের শিক্ষা দিতে লাগলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করার কৌশল ও প্রস্তুতি শেখাতে লাগলেন। এ খবর চলে গেল ইংরেজ শাসকদের কাছে। ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাল দেশি জমিদাররা। ১৮৩০ সালে ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে পাঠানাে হয় তিতুমীরকে দমন করবার জন্য। কিন্তু আলেকজান্ডার তাঁর সিপাহি বাহিনী নিয়ে পরাস্ত হন তিতুমীরের হাতে। তারপর তিতুমীর কয়েকটি নীলকুঠি দখল করে নেন।
১৮৩১ সালের ১৯শে নভেম্বর। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তখন ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল। তুমীরকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি পাঠালেন বিরাট সেনাবহর আর গােলন্দাজ বাহিনী। এর নেতৃত্ব দেওয়া হলাে সেনাপতি কর্নেল স্টুয়ার্ডকে। স্টুয়ার্ড আক্রমণ করলেন তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। তখন ভালাে করে ভাের হয়নি। আবছা আলাে। স্টুয়ার্ডের ছিল হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য আর অজস্র গােলাবারুদ। তিতুমীরের ছিল মাত্র চার-পাঁচ হাজার স্বাধীনতাপ্রিয় সৈনিক। তাঁর না ছিল কামান, না ছিল গােলাবারুদ, বন্দুক। তবে তাঁদের মনে ছিল পরাধীন দেশকে স্বাধীন করবার অমিত তেজ।
প্রচণ্ড যুদ্ধ হলাে। তিতুমীর আর তার বীর সৈনিকরা প্রাণপণ যুদ্ধ করলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ইংরেজ সৈনিকদের গােলার আঘাতে ছারখার হয়ে গেল নারকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লা। শহিদ হলেন বীর তিতুমীর। শহিদ হলেন অসংখ্য মুক্তিকামী বীর সৈনিক। তিতুমীরের ২৫০ জন সৈন্যকে ইংরেজরা বন্দি করল। কারাে হলাে কারাদণ্ড,কারাে হলাে ফসি। এভাবেই শেষ হলাে যুদ্ধ। কিন্তু এ যুদ্ধের বীর নায়ক তিতুমীর অমর হয়ে রইলেন এ দেশের মানুষের মনে। আজ থেকে প্রায় পৌনে দু শ বছর আগে তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে বীর তিতুমীরই হলেন বাংলার প্রথম শহিদ।
প্রশ্নগুলাের উত্তর মুখে বলি ও লিখি।
ক. তিতুমীর’ নামটি কেমন করে হলাে? তাঁর প্রকৃত নাম কী?
খ. এ দেশকে ইংরেজদের হাত থেকে মুক্ত করার চিন্তা কেন তার মনে এলাে?
গ, হিন্দু-মুসলমান সবাইকে তিনি কী বলে একতাবদ্ধ করতে চাইলেন?
ঘ. ইংরেজদের পাশাপাশি কারা এদেশের মানুষের ওপর অত্যাচার চালাত?
ঙ. নারকেলবাড়িয়া কোথায়? এখানে তিতুমীর কী তৈরি করলেন?
চ. কত খ্রিষ্টাব্দে তিতুমীরের কাছে ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়?
ছ, কখন কোন ইংরেজ সেনাপতির নেতৃত্বে তিতুমীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালিত হয়?
জ, তিতুমীর কীভাবে শহিদ হলেন?
ঝ. পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজ বিরােধী স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম শহিদ কে?
ঞ. শহিদ তিতুমীর কেন অমর হয়ে আছেন?
0 Comments