অমি ও আইসক্রিম’অলা -ফরিদুর রেজা সাগর


উঠোনের কোণার দিকে বিশাল যে গাছটা সেটা একটা নিমগাছ। নিমপাতা স্বাস্থ্যের জন্য ভালাে। চারপাশের গাছের এত সবুজ রঙের পাতা। ঘাসের বনে ছােট ছােট রঙিন ফুল আবার মনটাকে অন্যরকম করে দেয়। কিছুক্ষণ আগে শােনা যাচ্ছিলাে ঘুঘুর ডাক। একটু আগে একটা রঙিন পাখিও চোখে পড়েছে। পাখির পালকে অনেক রং। নাম না জানা পাখিটার একটা নাম ঠিক করে ফেলে অমি। পাখির নাম রঙিলা। 

ঠিক সে সময় চোখে পড়ল নীল রঙের হাফপ্যান্ট আর নীল রঙের হাফশার্ট পরা একটা লােক। দুচাকা’অলা একটা কাঠের বাক্স ঠেলে সামনে নিয়ে আসছে। লােকটা হেঁড়ে গলায় ডাক দিচ্ছে—আইসক্রিম।

এই জঙ্গলের মধ্যে লােকটা আইসক্রিম কার কাছে বিক্রি করবে? প্রথমেই প্রশ্নটা অমির মাথায় এলেও পরে মনে হলাে লােকটা কোথায়, কার কাছে, আইসক্রিম বিক্রি করবে তার জানার দরকার কী? বরং লােকটাকে ডেকে একটা আইসক্রিম কেনা যায়। জানালা দিয়ে অমি ডাক দেয়-আইসক্রিম’অলাকে।

দরজা খুলে বাইরে দাঁড়াতেই আইসক্রিম’অলা বলে, কী আইসক্রিম খাবেন?

বাপরে! এই জঙ্গলে আইসক্রিম পাওয়া যাচ্ছে এটাতাে বেশি। তারপর আবার কী আইসক্রিম পাওয়া যাবে তার পছন্দেরও সুযােগ রয়েছে। ভীষণ অবাক হয় অমি। কিন্তু মুখে বলে, 

কী ধরনের আইসক্রিম রয়েছে?
ভ্যানিলা, চকলেট, স্ট্রবেরি-আপনার কোনটা লাগবে?
ভ্যানিলাই দিন।
আপনি কি নতুন এসেছেন? 

কালাম সাহেব কোথায়?
অফিসে।
আপনি কালাম সাহেবকে চিনেন?
তিনি আপনার কে হন?
মামা।
আপনি বেড়াতে এসেছেন?
ঠিক বেড়াতে নয়। 
তবে ময়মনসিংহ যাচ্ছিলাম। গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায়
ও বুঝেছি! গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কালাম সাহেবের এখানে এসেছেন।
আজই কি চলে যাবেন?
আজ নয় কাল ফিরব। অমি বলল, জায়গাটা খুব সুন্দর। আগে আরও সুন্দর ছিল।
সেটা কী রকম? এই বাড়িটা জমিদার রায় বল্লভ রায়ের।
রায় বল্লভ রায় । 
হ্যা। খুব কম জমিদারই আছে যাদের নামের আগে পরে দুবার রায় লেখা হয়।
সেই জমিদার এখন কোথায়?
এই বাড়ির ভিতরেই আছে।
মানে?
বসার ঘরে। জমিদার সাহেবের একটা বিশাল ছবি টাঙানাে আছে। 
ও। আমার পুরাে বাড়ি দেখা হয় নি।
সময় পেলে দেখে নিবেন।
আমার আইসক্রিম দিলেন না?
মুখে যদিও লােকটা বলল ও! তাইতাে।
কিন্তু তারপরই আবার অমিকে বলল, একসময় এই বাড়িটার অনেক জৌলুস ছিল।
সেটা অবশ্য আমি কাল রাতেই বুঝেছি।
কেমন করে?
মামা বললেন, বাড়িটা অনেক বড়। এত রাতে দেখার দরকার নেই।
তাই বুঝি খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছেন?
হ্যা।
বাড়ির ভিতর একটা ফোন রয়েছে। অবশ্য ফোনটা এখন নষ্ট। নষ্ট হবারই কথা। এই বাড়ির অনেক কিছুই। এখন নষ্ট।

কী রকম?
পুরাে বাড়ির প্রত্যেক ঘরে বড় দেয়াল ঘড়ি ছিল।
সেগুলাে সবই নষ্ট। বসার ঘরে টানা পাখা ছিল। সেটাই এখন কেউ চালায় না।
টানা পাখা নষ্ট হয় কখনাে?
নষ্ট হয় না। কিন্তু দড়িগুলাে সব পুরনাে হয়ে ছিড়ে গেছে।
বাড়িটার কেউ কোনাে যত্ন নেয় না কেন? 
সে প্রশ্ন তাে আমারও।

এই ধরনের বাড়ির সরকারের উচিত রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা। আপনার মতাে সবাই যদি ব্যাপারটা বুঝতে পারত..... যাই হােক গলাটা একদম শুকিয়ে গেছে। একগ্লাস পানি খাওয়াবেন?

ভারি মজার ব্যাপার তাে? কোনাে আইসক্রিম’অলা পানি খেতে চায়? এমন কথা কখনাে শােনেনি অমি।
অবশ্য ময়রা নিজের মিষ্টি খায় না। সুতরাং আইসক্রিম’অলা নিজের আইসক্রিম না-ও খেতে পারে।
আপনি দাঁড়ান। আমি পানি এনে দিচ্ছি।
বাড়িতে আর কেউ নেই?
নাহ। আবদুল চাচা ছিলেন। তিনিও বাজারে গিয়েছেন।
দুঃখিত। আমার জন্যে আপনাকে কষ্ট করতে হচ্ছে। 

, না। পানি খেতে চেয়েছেন তাে কষ্টের কী আছে?
অমি ঘরের ভিতরে চলে যায়। ওর ঘরে জগের মধ্যে পানি রাখা। জগ থেকে গ্লাসে পানি রাখতে গিয়ে অবাক অমি। কী আশ্চর্য। জগ একদম খালি। অথচ ওর স্পষ্ট মনে আছে- আবদুল চাচা জগ ভরে পানি রেখে বলে গিয়েছিল,
এই জগে পানি রইল। বিকেলে আবার পানি ফোটাব।
অমি বলেছিল, আর দরকার হবে না। এক জগ পানিতে আমার কাল সকাল পর্যন্ত চলবে।
আবদুল চাচার কথায় বােঝা যাচ্ছে ঘরে আর খাবার পানি নেই। বাথরুমের কলের দিকে চোখ পড়ে অমির। কিন্তু কলের প্যাঁচ খুলছে না।

দুই

এত বড় বাড়ি। কোথায় খুঁজবে পানি। অমি খালি গ্লাসটা নিয়ে আবার বাইরে এসে দাঁড়ায়।
কী পানি পেলেন?
মাথা নিচু করে থাকে অমি।
দেখলেন তাে এত বড় বাড়ি কিন্তু একফোঁটা পানি পেলেন না। কী দুর্ভাগ্য। সত্যি ব্যাপারটা বড় দুর্ভাগ্যের।
এই দুর্ভাগ্য এড়াতে পারে নি রাজা রায় বল্লভ রায়ও।
রাজার আবার দুর্ভাগ্য হয় কী করে?
সেই তাে কথা। যে রাজার নামের ডাকে সব প্রজারা এক হয়ে যেত সেই রাজার ভাগ্যের এমন পরিণতি হবে তা কেউ ভাবে নি। 
কী হয়েছিল রাজার?
একাত্তরের কথা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঘটনাটা ঘটেছিল। কী ঘটনা? 

ঠিক সেসময় হঠাৎ করে গাড়ির হর্নের শব্দ শােনা যায়। ড্রাইভার বােধহয় গাড়ি নিয়ে ফিরে আসছে। অমি আইসক্রিম’অলাকে বলল,
আমাদের গাড়ি ফিরে আসছে। গাড়িতে পানির বােতল আছে। আপনাকে পানি দেব।
ঠিক আছে। তবে বােধহয় সেটা লাগবে না।
অদ্ভুতভাবে লােকটি দুই চাকাঅলা আইসক্রিমের কাঠের বাক্সটা নিয়ে কিছু বলার আগেই নিমিষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।
ড্রাইভার এসে চাবি দিয়ে চলে যায়। আর কী আশ্চর্য-ভােজবাজির মতাে আবার আইসক্রিম’অলা আইসক্রিমের বাক্স নিয়ে উপস্থিত হয় অমির সামনে। হঠাৎ করেই অমির মনে হলাে, একটু আগে যে আইসক্রিম’অলাকে অমি দেখেছিল সেই একই আইসক্রিম’অলা। কিন্তু তার বয়স বেড়ে গেছে অনেক।
আগের আইসক্রিম’অলার মােচ ছিল কিনা সেটাও মনে করতে পারছে না অমি।
আপনি আবার ফিরে এলেন যে।
আপনার আইসক্রিমটা দিতে ভুলে গেছি।
আমিও পানি দিতে ভুলে গেছিলাম।
এই কথা বলে অমি গাড়ির দিকে এগােয়।
আইসক্রিম’অলা বলে, এখন পানি আর খেতে ইচ্ছা করছে না। বরং আপনি কী আইসক্রিম যেন খাবেন বলেছিলেন।
যখন আমি তার ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছিল তখন ঐটুকু সময়ের মধ্যে লােকটা কোথায় গিয়েছিল? অমির কথাটা মনে হওয়ার কারণ আইসক্রিম’অলা লােকটি হঠাৎ যেন খুব পরিশ্রান্ত হয়ে গেছে। কথা বলতে গিয়ে হাঁপাচ্ছে।
আপনি আমাকে রাজা রায় বল্লভ রায়ের দুর্ভাগ্যের কথা বলতে যাচ্ছিলেন।
কার গল্প!
অমি আবার বলে, রাজা রায় বল্লভ রায়।
আমি শুনতে পাচ্ছি না। একটু জোরে বলবেন?
চিৎকার করে অমি বলে। রাজা রায় বল্লভ রায়।
এই নাম আপনি কোত্থেকে জানলেন অমি সাহেব?
অমি হঠাৎ খেয়াল করে ওর পুরাে গা ধরে ঝাঁকাচ্ছে বাড়ির কেয়ারটেকার আবদুল চাচা। আর বলছে, এই নাম আপনি কী করে জানলেন?

ঐ তাে উনি বলেছেন।
কে বলেছেন?
ঐ আইসক্রিম’অলা।
এই জঙ্গলে আইসক্রিম’অলা আসবে কোথা থেকে? কী বলছেন অমি সাহেব।
এই তত এখনই আমার সাথে কথা বলছিল। কোথায় গেল? কিছুক্ষণ আগে ড্রাইভার আসার সময় যেমন ভােজবাজির মতাে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল আইসক্রিম’অলা আবদুল চাচা আসার সময়ও ঠিক সেরকম কাণ্ড ঘটেছে। চোখের সামনে কেউ নেই।
গেল কোথায় লােকটা? চাচা এদিকে আসেন, খুঁজে দেখি।
খোঁজার দরকার নাই। 
কেন? 
সত্যি সত্যি কেউ আসে নি। বিশ্বাস করেন আবুদল চাচা, আমি অনেকক্ষণ ধরে লােকটার সাথে কথা বলেছি। এমনকি তার জন্যে পানিও আনতে গেছি।
বলতে বলতে অমি আবদুল চাচাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।
লােকটিকে তুমি পানি দিয়েছিলে?
কেমন করে দেব? তুমি জগে পানি রেখে যাও নি?
আমি নিজের হাতে পানি রেখে গেছি। এইতাে জগ-ভরা পানি।
আবদুল চাচা সামনে গিয়ে জগটা দেখায়। অমি অবাক হয়ে দেখে, তাইতাে! জগ-ভরা পানি।
একটু আগে অমি তাহলে কী দেখেছে? 
আমি কলেও পানি পাই নি।
কেন?
কলের প্যাচ খুলছিল না।
এই বাড়ির সবগুলাে কলের পঁাচ উল্টোদিকে। সেটা আপনি বুঝতে পারেন নি।
উল্টোদিকে কেন?
রাজা রায় বল্লভ রায় আমেরিকায় গিয়েছিলেন। আমেরিকায় কল উল্টোদিক ঘােরালে পানি আসে। লাইটের সুইচ উল্টোদিকে টিপে বাতি জ্বলে। এ বাড়ির সবকিছু সেই আমেরিকার নিয়মে করে গেছেন রাজা মশাই।
সেই রাজা মশাই কোথায়?
সেটা কেউ জানে না।
জানে না মানে?
একাত্তর সালে পাকিস্তানি সৈন্যরা এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় এই বাড়িতেও ঢুকেছিল। শােনা যায়, সেই সময় স্থানীয় একজন মাতব্বর মাহতাবউদ্দিন রাজাকে খুন করে এই বাড়ির দখল নিয়েছিল। রাজাকে খুন করে?

হা। পঁচিশ মার্চের পরে রাজার পুরাে পরিবার বিদেশে চলে গিয়েছিল। কিন্তু রাজা বলতেন, তিনি এই এলাকার রাজা। প্রজাদের ছেড়ে কোথাও যাবেন না। তবে তার দুর্ভাগ্য পাকিস্তানি সৈন্যদের আসার খবর পেয়ে তার দেহরক্ষী ও প্রজারা সবাই পালিয়ে গিয়েছিল।

মাহতাবউদ্দিন আহমদ এখন কোথায়? পালিয়ে গেছে। কেউ কেউ বলে, মাঝে মাঝে এই বাড়ি দখল নেয়ার চেষ্টা সে নানাভাবে করে। কিন্তু আপনার মামার জন্য সেটা সম্ভব হয় নি। বরং এই এলাকার অনেকে এই ঘটনা জানতে পেরে এখনও মাঝে মাঝে মাহতাবউদ্দিন আহমেদের বিচার দাবি করে।

কিন্তু রাজা রায় বল্লভ রায় যে মারা গেছেন তার কোনাে প্রমাণ আছে?
না। সেটাই সবচেয়ে বড় রহস্য। তবে লােকে বলে এই এলাকায় মাঝে মাঝে রাজা রায় বল্লভ রায়ের মতাে একই চেহারার মানুষ দেখা যায়।
আমিও কি আজ সেরকম কাউকে দেখেছি?
জানি না। কিন্তু এর আগেও শুনেছি এই বাড়ির দরজা পর্যন্ত রাজার চেহারার মতাে অনেককে দেখা গেছে।

রাজা এই বাড়ির ভিতরে এসেছেন এমন কাউকে শােনা গেছে? না। তবে তার একটা বড় কারণ ঠিক বাড়ির সামনে যে নিমগাছটা রয়েছে সেটা।
নিমগাছে তাে ভূত থাকে শুনেছি।
লােকে সেটা বলে। কিন্তু আসলে অনেক গুণ রয়েছে। অমি আর কথা আগায় না। নিমগাছের ভূত-এসব আলােচনা তার ভালাে লাগছে না। আবদুল চাচা এই সময় বলে, এই বাড়ির কাচারিঘরে রাজার একটা ছবি রয়েছে দেখবেন?
হা-অবশ্যই।
কাচারিঘরের দিকে এগােয় অমি। দেয়ালে একটা বিরাট তৈলচিত্র। একটু আগে যে আইসক্রিম’অলার সঙ্গে অমি কথা বলছিল হুবহু সেই চেহারা। শুধু ছবির লােকটার পরনে রাজকীয় পােশাক। এই হলাে রাজা রায় বল্লভ রায়ের ছবি। আর রাজার প্রিয় খাবার ছিল আইসক্রিম। বলা হয়, তিনবেলাই খাবারের সঙ্গে রাজা আইসক্রিম খেতে পছন্দ করতেন। 

তিন 

অমি নটরডেম কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। ভূতের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে এটা কোনােমতেই মানতে রাজি নয় সে। কিন্তু একজন আইসক্রিম’অলার সাথে তার কথা হয়েছে সেই ব্যাপারেও কোনাে ভুল নেই। আবদুল চাচা নিমগাছের কথা বলে আসলে ভূতেরই ইঙ্গিত দিয়েছে সেটা বুঝতে পারছে অমি। সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। কাল সকালে এই বাড়ি ছেড়ে অমি চলে যাবে। কোনােদিন আর এই বাড়িতে ফিরে আসবে কিনা তা সে জানে না।

কী? আপনার আইসক্রিমটা নেবেন না?
চমকে সামনের দিকে তাকায় অমি।।
সেই আইসক্রিম’অলা। সেই কাঠের বাক্স।
আপনি আইসক্রিম দেবেন কেমন করে। কেন এই বাক্স থেকে। বাক্সে কী আছে জানি না।

কিন্তু আপনি যে আইসক্রিমঅলা নন সেটা আমি জানি।
তােমাকে আবদুল সব বলে দিয়েছে?
হ্যা। কিন্তু আপনি কেন এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? কী চান?
আমি যা চাই তা তুমি দিতে পারবে?
কেন পারব না? স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে ইচ্ছা করলে সবই পারি।
তাহলে যে লােকটি আমাকে মেরেছে, আমার বাড়ি ধ্বংস করেছে তার বিচার করতে হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করেছে তাদের বিচার করতে হবে। 

অমি ভাই তুমি কোথায়, দ্যাখাে কী সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটেছে। পেছন থেকে আবদুল চাচার চিকার এবং একই সাথে চোখের সামনে থেকে আইসক্রিম’অলা তথা রাজা রায় বল্লভ রায়ের ভােজবাজির মতাে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।
কী হয়েছে আবদুল চাচা, এমন চেঁচাচ্ছেন কেন?
কাচারিঘরে এসাে, দ্যাখাে কী সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটছে।
আবদুল চাচা হাত ধরে প্রায় দৌড়ে নিয়ে যায় কাচারিঘরের দিকে। আগে খেয়াল করে নি অমি। রাজার যে ছবিটা রয়েছে সেই ছবিটায় রাজার একটা হাত উপরে উঠে রয়েছে।

আর সেই হাতে ধরা রয়েছে একটা আইসক্রিম।

এই আইসক্রিম থেকেই পানির মতাে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ছে কোনাে একটা তরল পদার্থ। আর যেখানেই তরল পদার্থ পড়ছে সেখান থেকেই ছবির অংশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ইতােমধ্যেই ছবির প্রায় অর্ধেক অংশ সাদা হয়ে গেছে। আবদুল চাচা চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। তবে অমি বােধহয় জানে এই ছবিটা যেমন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তেমনি রাজা রায় বল্লভ রায় এই এলাকার মানুষের চোখের সামনে আর আসবে না। কারণ তিনি তার শেষ ইচ্ছার কথা অমিকে জানিয়ে গেছেন। 

লেখক-পরিচিতি ২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫ সালে ফরিদুর রেজা সাগর ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন। বাবা ফজলুল হক এদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সাংবাদিকতার পথিকৃত এবং চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রথম পত্রিকা ‘সিনেমা’র সম্পাদক ছিলেন। ফরিদুর রেজা সাগর শিশুসাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০০৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। প্রায় শতাধিক গ্রন্থের লেখক ফরিদুর রেজা সাগরের লেখা ‘ছােট কাকু সিরিজ’ ছােট বড় সকলের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অভিযান, রহস্য, ভ্রমণ, স্মৃতিকথা, ভূত, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি তাঁর প্রিয় বিষয়। এইসব বিষয় নিয়ে কেবল ছােটদের জন্য তিনি প্রায় পঁচিশটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে। চলচ্চিত্র প্রযােজনার জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বর্তমানে তিনি ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড এবং চ্যানেল আই-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। 

সারসংক্ষেপ: ফরিদুর রেজা সাগর রচিত ‘অমি ও আইসক্রিম’অলা’ একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রূপকাশ্রয়ী গল্প। ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে গাড়ি নষ্ট হওয়ায় রাস্তার পাশে বনের মধ্যে একটি পরিত্যক্ত জমিদারবাড়িতে নটর ডেম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র অমিকে অবস্থান করতে হয়। সেখানে তার মামা থাকেন। বাড়িতে আছে একজন কেয়ারটেকার আবদুল। বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধ শহিদ জমিদার রায় বল্লভ রায়ের। অমি যখন একা থাকে তখন একজন আইসক্রিমঅলাকে দেখতে পায়। মানুষের সমাগম হলে আবার সে হারিয়ে যায়। এ আইসক্রিমঅলাই জমিদার রায় বল্লভ রায়ের অশরীরী আত্মা। যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতাকারীদের ও বিচারে জনগণকে সােচ্চার হওয়ার জন্য-অমির কাছে তিনি তার শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

শব্দার্থ : জৌলুস – চাকচিক্য, উজ্জ্বলতা। টানাপাখা – হাত দিয়ে রশির সাহায্যে যে পাখা টানা হয়। টেনসন – দুশ্চিন্তা। ভােজবাজি-ইন্দ্রজাল। ময়রা – যে মিষ্টি তৈরি করে। কেয়ারটেকার তত্ত্বাবধায়ক। তৈলচিত্র— তেলরঙে অঙ্কিত ছবি। কাচারিঘর – সাধারণত বাহিরের মানুষের ব্যবহারের জন্য মূল ঘরের একটু দূরে যে ঘর । 

সৃজনশীল প্রশ্ন নেওয়াজ দশম শ্রেণিতে পড়ে। সে বন্ধুদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখতে যায়। ঘুরে ঘুরে জাদুঘর দেখে তার যেমন গৌরববােধ হয় তেমনি কান্নাও পায়। সে গৌরববােধ করে। তার দাদা একজন শহিদ মুক্তিযােদ্ধা। তার কাছে মনে হলাে- শহিদ মুক্তিযােদ্ধারা যেন চিৎকার করে বলছেন ‘না, না-ঘাতকদের ক্ষমা করাে না। 
ক, আইসক্রিমঅলা অমির কাছে কী চেয়েছে? 
খ. “ভােজবাজি” বলতে কী বােঝায়? 
গ. গল্পের অমির কোন দিকটি উদ্দীপকের নেওয়াজের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ তা ব্যাখ্যা কর। 
ঘ. “মূল চেতনায় ‘অমি ও আইসক্রিম’অলা’ এবং উদ্দীপক অভিন্ন বক্তব্যের ধারক।”- উক্তিটি মূল্যায়ন কর। 




Post a Comment

0 Comments