পাত্রগণ : পথিক। ঝুড়িওয়ালা। বৃদ্ধ। হােকরা। খােকা। মামা।
প্রথম দৃশ্য
রাজপথ (ছাতা মাথায় এক পথিকের প্রবেশ। পিঠে লাঠির আগায় লােটা-বাঁধা পুটলি। উষ্কখুষ্ক চুল। ভ্রান্ত চেহারা) পথিক : নাঃ একটু জল না পেলে আর চলছে না। সেই সকাল থেকে হেঁটে আসছি, এখনও প্রায় এক ঘণ্টার পথ বাকি। তেষ্টায় মগজের ঘিলু পর্যন্ত শুকিয়ে উঠল। কিন্তু জল চাই কার কাছে?
গেরস্তর বাড়ি, দুপুর রােদে দরজা এঁটে সব ঘুম দিচ্ছে, ডাকলে সাড়া দেয় না। বেশি চ্যাঁচাতে গেলে হয়তাে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে। পথেও লােকজন দেখছিনে।- ওই একজন আসছে! ওকেই জিজ্ঞেস করা যাক।
[ঝুিড়ি মাথায় এক ব্যক্তির প্রবেশ]
পথিক : মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?
ঝুড়িওয়ালা : জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? এ তাে জলপাইয়ের সময় নয়। কাঁচা আম চান তাে দিতে পারি -
পথিক : না, না আমি তা বলিনি –
ঝুড়িওয়ালা : না,কাঁচা আম আপনি বলেননি, কিন্তু জলপাই চাচ্ছিলেন কিনা, তা তাে আর এখন পাওয়া যাবে না, তাই বলছিলুম –
পথিক : না হে, আমি জলপাই চাচ্ছিনে –
ঝুড়িওয়ালা : চাচ্ছেন না তাে, কোথায় পাব কোথায় পাব’ কচ্ছেন কেন? খামাখা এরকম করবার মানে কী?
পথিক : আপনি ভুল বুঝছেন- আমি জল চাচ্ছিলাম
ঝুড়িওয়ালা : জল চাচ্ছেন তাে ‘জল’ বললেই হয়- ‘জলপাই’ বলবার দরকার কী? জল আর জলপাই কি এক হলাে? আলু আর আলুবােখরা কি সমান? মাছও যা আর। মাছরাঙ্গাও তাই? বরকে কি আপনি বরকন্দাজ বলেন? চাল কিনতে গিয়ে কি চালতার খোঁজ করেন?
পথিক : ঘাট হয়েছে মশাই। আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার অন্যায় হয়েছে।
ঝুড়িওয়ালা : অন্যায় তাে হয়েছেই। দেখছেন ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছি। তবে জল চাচ্ছেন কেন? ঝুড়িতে করে কি জল নেয়? লােকের সঙ্গে কথা কইতে গেলে একটু বিবেচনা করে বলতে হয়।
[ঝুড়িওয়ালার প্রথান] [পাশের বাড়ির জানালা খুলিয়া এক বৃদ্ধের হাসিমুখ বাহিরকরণ]
বৃদ্ধ : কী হে? এত তর্কাতর্কি কিসের?
পথিক : আজ্ঞে না, তর্ক নয়। আমি জল চাচ্ছিলুম, তা উনি সে কথা কানেই নেন - কেবলই সাত-পাঁচ গপপাে করতে লেগেছেন। তাই বলতে গেলুম তাে রেগেমেগে অস্থির।
বৃদ্ধ : আরে দূর দূর। তুমিও যেমন! জিজ্ঞেস করবার আর তােক পাওনি? ও হতভাগা জানেই বা কী আর বলবেই বা কী? ওর যে দাদা আছে, খালিসপুরে চাকরি করে। সেটা তাে একটা আস্ত গাধা। ও মুখটা কী বলবে তােমায়?
পথিক : কী জানি মশাই-জলের কথা বলতেই কুয়াের জল, নদীর জল, পুকুরের জল, কলের জল, মামাবাড়ির জল বলে পাঁচ রকম ফর্দ শুনিয়ে দিলে
বৃদ্ধ : স্টুঃ-ভাবলে খুব বাহাদুরি করেছি। তােমায় বােকামতাে দেখে খুব চাল চেলে নিয়েছে। ভারি তাে ফর্দ করেছেন, আমি লিখে দিতে পারি, ও যদি পাঁচটা জল বলে থাকে তাে আমি এক্ষুণি পঁচিশটা বলে দেব –
পথিক : না মশাই, গুনিনি-আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই - বৃদ্ধ : তােমার কাজ না থাকলেও আমার কাজ থাকতে পারে তাে? যাও, যাও, মেলা বকিয়াে না-একেবারে অপদার্থের একশেষ।
[বৃিদ্ধের সশব্দে জানালা বন্ধকরণ]। নেপথ্যে বাড়ির ভিতরে বালকের পাঠ]
[পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল। সমুদ্রের জল লবণাক্ত, অতি বিবাদ।]
পথিক : ওহে খােকা! এদিকে শুনে যাও তাে?
[রুক্ষমূর্তি, মাথায় টাক, লম্বা দাড়ি খােকার মামা বাড়ি হইতে বাহির হইলেন]
মামা : কে হে? পড়ার সময় ডাকাডাকি করতে এয়েছ? – (পথিককে দেখিয়া) ও! আমি
মনে করেছিলুম পাড়ার কোনও ছােকরা বুঝি! আপনার কী দরকার?
পথিক: আজ্ঞে, জলতেষ্টায় বড় কষ্ট পাচ্ছি-তা একটু জলের খবর কেউ বলতে পারলে না।
[মামার তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলিয়া দেওয়া]
মামা : কেউ বলতে পারলে না? আসুন, আসুন, কী খবর চান, কী জানতে চান, বলুন | দেখি? সব আমায় জিজ্ঞেস করুন, আমি বলে দিচ্ছি।
[পথিককে মামার ঘরে টানিয়া নেওয়া ]
দ্বিতীয় দৃশ্য
ঘরের ভিতর [ঘর নানা রকম যন্ত্র, নকশা, রাশি-রাশি বই ইত্যাদিতে সজ্জিত]।
মামা: কী বলছিলেন? জলের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না?
পথিক: আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি।
মামা: আ হা হা! কী উৎসাহ, কী আগ্রহ! শুনেও সুখ হয়। এরকম জানবার আকাঙ্ক্ষা
কজনের আছে, বলুন তাে? বসুন! বসুন! (কতকগুলি ছবি, বই আর এক টুকরাে খড়ি বাহির করিয়া) জলের কথা জানতে গেলে প্রথমে জানা দরকার, জল কাকে। বলে, জলের কী গুণ –
পথিক: আজ্ঞে, একটু খাবার জল যদি –
মামা: আসছে -ব্যস্ত হবেন না। একে একে সব কথা আসবে। জল হচ্ছে দুইভাগ হাইড্রোজেন আর একভাগ অক্সিজেন।
পথিক: এই মাটি করেছে!
মামা: বুঝলেন? রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জলকে বিশ্লেষণ করলে হয়-হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। আর হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের রাসায়নিক সংযােগ হলেই, হবে । জল! শুনছেন তাে?
পথিক: দেখুন মশাই! কী করে যে কথাটা আপনাদের মাথায় ঢােকাব তা ভেবে পাইনে। বলি, বারবার করে যে বলছি- তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, সেটা তাে কেউ কানে নিচ্ছেন না দেখি। একটা লােক তেষ্টায় জল জল করছে, তবু জল খেতে পায় না, এরকম কোথাও শুনেছেন?
মামা: শুনেছি বইকি, চোখে দেখেছি। বদ্যিনাথকে কুকুড়ে কামড়াল, বদ্যিনাথের হলাে হাইড্রোফোবিয়া- যাকে বলে জলাতঙ্ক। আর জল খেতে পারে না-যেই জল খেতে যায় অমনি গলায় খিচ ধরে। মহা মুশকিল।
পথিক: নাঃ এদের সঙ্গে পেরে ওঠা গেল না-কেনই মরতে এসেছিলাম এখানে? বলি মশাই, আপনার এখানে নােংরা জল আর দুর্গন্ধ জল ছাড়া ভাললা জল খাঁটি জল কিছু নেই?
মামা: আছে বইকি! এই দেখুন না বােতল-ভরা টাটকা খাঁটি ডিস্টিল ওয়াটার-যাকে বলে পরিশ্রত জল।
[বিড় সবুজ একটি বােতল আনিয়া মামা পথিককে দেখাইলেন]
পথিক: (ব্যস্ত হইয়া) এ জল কি খায়?
মামা: না, ও জল খায় না, ওতে তাে বাদ নেই- একেবারে বােবা জল কিনা, এইমাত্র তৈরি করে আনল- এখনও গরম রয়েছে। তাশ ভাব] তারপর যা বলছিলুম শুনুন- এই যে দেখছেন গধওয়ালা নােংরা জল- এর মধ্যে দেখুন এই গােলাপি জল ঢেলে দিলুম- ব্যস, গােলাপি রং উড়ে সাদা হয়ে গেল। দেখলেন তাে?
পথিক: না মশাই, কিচ্ছু দেখিনি, কিচ্ছু বুঝতে পারিনি, কিচ্ছু মানি না ও কিছু বিশ্বাস করি না।
মামা: কী বললেন। আমার কথা বিশ্বাস করেন না?
পথিক: না, করি না। আমি যা চাই, তা যতক্ষণ দেখাতে না পারবেন, ততক্ষণ কিছু বিশ্বাস করব না।
মামা : বটে, কোনটা দেখতে চান একবার বলুন দেখি আমি চোখে আঙ্গুল দিয়ে
দেখিয়ে দিচ্ছি।
পথিক : তা হলে দেখান দেখি। সাদা, খাঁটি চমৎকার এক গেলাস খাবার জল নিয়ে দেখান
দেখি। যাতে গন্ধ নেই, পােকা নেই, কলেরার পােকা নেই, ময়লা-টয়লা কিচ্ছু নেই, তা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখান দেখি। খুব বড় এক গেলাস ভর্তি জল নিয়ে
দেখান তাে! মামা।
মামা: এক্ষুণি দেখিয়ে দিচ্ছি- ওরে ট্যাপা, দৌড়ে আমার কুঁজো থেকে এক গেলাস জল নিয়ে আয় তাে।
[পাশের ঘরে দুপদাপ শব্দে খােকার দৌড়। নিয়ে আসুক, তারপর দেখিয়ে দিচ্ছি। ওই জলে কী রকম হয়, আর নােল্লা জলে কী রকম তফাত হয়, আমি সব দেখিয়ে দিচ্ছি। (জল লইয়া ট্যাপার প্রবেশ] এই খানে রাখ। জিল রাখিবামাত্র পথিকের আক্রমণ- মামার হাত হইতে জল কাড়িয়া এক নিঃশ্বাসে চুমুক দিয়া শেষ করা]
পথিক : আঃ বাঁচা গেল!
মামা : (চটিয়া) এটা কী রকম হলাে মশাই? পথিক : পরীক্ষা হলাে- এক্সপেরিমেন্ট। এবার আপনি নােংরা জলটা একবার খেয়ে দেখান তাে? কীরকম হয়? মামা : (ভীষণ রাগিয়া) কী বললেন? পথিক : আচ্ছা থাক, এখন নাই বা খেলেন- পরে খাবেন। আর গাঁয়ের মধ্যে আপনার মতাে আনকোরা পাগল আর যতগুলাে আছে, সবকটাকে খানিকটা করে খাইয়ে দেবেন। তারপর খাটিয়া তুলবার দরকার হলে আমায় খবর দেবেন- আমি খুশি হয়ে ছুটে আসব, হতভাগা জোচ্চোর কোথাকার।
[পথিকের দ্রুত প্রস্থান] [পাশের গলিতে সুর করিয়া সে হাঁকিতে লাগিল - ‘অবাক জলপান'।
0 Comments