কাঞ্চনমালা আর কাকনমালা


অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার একটাই পুত্র। রাজপুত্রের সঙ্গে সেই রাজ্যের রাখাল ছেলের খুব ভাব। দুই বন্ধু পরস্পরকে খুব ভালােবাসে। রাখাল মাঠে গরু চরায়, রাজপুত্র গাছতলায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করে। নিঝুম দুপুরে রাখাল বাঁশি বাজায়।। রাজপুত্র তার বন্ধু রাখালের গলা জড়িয়ে বসে সেই সুর শােনে। বন্ধুর জন্য বাঁশি বাজিয়ে রাখাল বড় সুখ পায়। আর, তা শুনে রাজপুত্রের মন খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে। রাজপুত্র বন্ধুর কাছে প্রতিজ্ঞা করে, বড় হয়ে রাজা হলে রাখালকে তার মন্ত্রী বানাবে। 

তারপর একদিন রাজপুত্র রাজা হয়। লােকলস্কর, সৈন্যসামন্তে গমগম করে তার রাজপুরি। রাজপুরি আলাে করে থাকে রানি কাঞ্চনমালা। চারদিকে সুখ। এত সুখের মধ্যে রাখালবন্ধুর কথা মনে পড়ে না। রাজপুত্র বধুকে ভুলে যায়। 


এদিকে, রাখালবপুর কিন্তু খুব মনে পড়ে বন্ধু রাজপুত্রের কথা। শেষে সে একদিন চলেই আসে বন্ধুকে একটুখানি দেখার জন্য। কিন্তু রাজপ্রাসাদের রক্ষীরা অমন গরিব রাখালকে ভিতরে ঢুকতে দেয় না। মনভরা কষ্ট নিয়ে সারাদিন প্রাসাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। রাজার দেখা মেলে না। দিনশেষে মনের কষ্ট নিয়ে দুঃখী রাখাল চলে যায়, কেউ তা জানে না। এক রাতে রাজা ঘুমাতে যান। কিন্তু ভােরবেলা যখন তার ঘুম ভাঙে, তখনই দেখা যায় কী সর্বনাশ ঘটেছে! রাজা দেখেন যে তার শরীরে গেঁথে আছে অগুনতি সুচ। রাজা কথা বলতে পারেন, শুতে পারেন না, খেতেও পারেন না। রাজ্যজুড়ে কান্নাকাটির রােল পড়ে যায়। রাজা বােঝেন - প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের সেই অপরাধেই আজকে তার এই দশা। রানি কাঞ্চনমালা চোখের জল মুছতে মুছতে রাজ্য দেখাশােনা শুরু করেন। কাঞ্চনমালা একদিন নদীর ঘাটে স্নান করতে যান। কোথা থেকে জানি একটা মেয়ে এলাে। এসে তাকে বলে, রানির যদি দাসীর দরকার হয়, তাে সে দাসী হবে। রাজার শরীর থেকে সুচ খােলার জন্য একজনের দরকার ছিল রানি কাঞ্চনমালার। মেয়েটাকে সেই কাজের জন্য নিয়ে নেন রানি। নদীর ঘাটে গেছেন রানি, সঙ্গে কী করে থাকে টাকাকড়ি! তখন হাতের সােনার কাকন দিয়েই রানিকে কিনতে হয় ওই দাসী। তাই তার নাম কঁাকনমালা। গায়ের গয়নাগুলাে কাঁকনমালার কাছে রেখে নদীতে ডুব দিতে যান রানি। চোখের পলকে কাঁকনমালা রানির সব গয়না আর শাড়ি পরে নেয়। রানি ডুব দিয়ে উঠে দেখেন দাসী হয়ে গেছে রানি, আর রানি কাঞ্চনমালা হয়ে গেছেন দাসী। 

নকল রানি কাঁকনমালার ভয়ে কাঁপতে থাকে কাঞ্চনমালা। কাঁপতে থাকে রাজপুরীর সকলে। সকলে ভাবতে থাকে, তাদের রানি তাে আগে এমন ছিল না। সুচবিধা রাজা জানতেই পারেন না, তার রাজ্যে আরেক কী ঘাের ঝামেলা এসে গেছে। দুখিনী কাঞ্চনমালা রাজবাড়ির সকল কাজকর্ম করেন। চোখের জল ফেলেন। 

হাতে কাঞ্চনমালার একটুও ফুরসত থাকে না। কীভাবে সুচরাজার যত্ন করবে! কীভাবে তার পাশে দুদন্ড বসবে। নকল রানি রাজার দিকে ফিরেও তাকায় না। রাজার কষ্টের সীমা থাকে না। সুবিধা শরীর ব্যথায় টনটন করে, চিনচিন করে জ্বলতে থাকে। গায়ে মাছি এসে বসে আঁকে ঝকে। কে তাকে বাতাস করে, কে তাকে দেখে! একদিন নকল রানি কাঞ্চনমালাকে একগাদা কাপড় ধুতে পাঠায় নদীর ঘাটে। মাথায় কাপড়ের বােঝা নিয়ে কাঞ্চনমালা এক পা এগােন এক পা থামেন। চোখের জলে তার বুক ভেসে যেতে থাকে। এমন সময় কাঞ্চনমালা শােনেন, বনের পাশের গাছতলা থেকে কেমন এক অদ্ভুত মন্ত্র। কে জানি বলেই যাচ্ছে: পাই এক হাজার সুচ তবে খাই তরমুজ। সুচ পেতাম পাঁচ হাজার তবে যেতাম হাট বাজার। যদি পাই লাখ তবে দেই রাজ্যপাট।

মাথার বােঝা নামিয়ে কাঞ্চনমালা যান ছুটে তার। কাছে। বলেন, লাখ লাখ। সুচ চাও তাে? আমি দিতে পারি। এ কথা শুনে সেই মানুষ ঝটপট তার সুতার পুঁটলি তুলে নিয়ে কাঞ্চনমালার সাথে হটা ধরে। যেতে যেতে পথে কাঞ্চনমালা চোখের জল ফেলতে ফেলতে দুঃখের সব কথা বলে। অচেনা মানুষ শােনে, মুখ থমথমে হয়ে যেতে থাকে তার। রাজপুরীতে গিয়ে ওই অচিন মানুষ সুচ নেবার কথাটাও বলে না। বলতে থাকে অন্য কথা। বলে, আজকের দিন বড় শুভ দিন। আজ হচ্ছে পিটকুড়ুলির ব্রত, আজকের দিনে রানিদের পিঠা বিলাতে হয়- এমনই নিয়ম। নকল রানি পিঠা বানাতে যায়। সে কাঞ্চনমালাকেও পিঠা বানাতে ফরমাস দেয়। নকল রানি বানায় পিঠা। সে পিঠা কেউ মুখেও তুলতে পারে না, এমনই বিবাদ। দুখিনী কাঞ্চনমালা বানান চন্দ্রপুলি, মােহনবাশী, ক্ষীর মুরলি পিঠা। মুখে দেওয়া মাত্র সকলের মন ভরে যায়। এমনই স্বাদ তার। নকল রানি উঠানে আল্পনা দিতে যায়। কোথায় নকশা কোথায় কী এখানে এক খাবলা রং লেপে দেওয়া, ওখানে এক খাবলা লেপা। দেখতে যে কি অসুন্দর দেখায়। আর কাঞ্চনমালা আঁকেন পদ্মলতা। তার পাশে আঁকেন সােনার সাত কলস, ধানের ছড়া, ময়ূর পুতুল।

লােকে তখন বুঝতে পারে কে আসল রানি, আর কে দাসী। 
তখন সেই অচেনা মানুষটা কাঁকনমালাকে ডাক দেয়, বলে-হাতের কাঁকনে কেনা দাসী, জলদি সত্যি কথা বল। কঁকনমালার সেকি রাগ। সে গর্জে উঠে জল্লাদকে হুকুম দেয়, অচেনা মানুষ আর কাঞ্চনমালার গর্দান নিতে। জল্লাদ ওদের ধরতে আসার আগেই অচেনা মানুষ তার সুতার পুঁটলিকে হুকুম দেয়। এক গােছা সুতা গিয়ে জল্লাদকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। নকল রানি আবার গর্জে ওঠার আগেই অচিন মানুষ নতুন মন্ত্র পড়া ধরে: 

সূতন সূতন সরুলি, কোন দেশে ঘর 
সুচ রাজার সুচ গিয়ে আপনি পর। সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ সুতা রাজার গায়ের লাখ লাখ সুচে ঢুকে যায়। আবার মন্ত্র পড়ে অচিন মানুষ। সব সুচ রাজার শরীর থেকে বেরিয়ে এসে নকল রানির চোখেমুখে বিধে যায়। জ্বালা যন্ত্রণায় ছটফট করে। নকল রানি শেষে মারা যায়। কাঞ্চনমালার দুঃখের দিন শেষ হয়। 

এদিকে, রাজা বহু বছর পরে চোখ মেলেন। সামনে কে যেন দাঁড়িয়ে! কে! সেই রাখালবধু! রাজা দুহাতে জড়িয়ে ধরেন তাকে। রাজা ক্ষমা চান তার বন্ধুর কাছে। কথা দিয়ে কথা রাখেননি। রাজা বলেন, আজ থেকে তুমি আমার মন্ত্রী। এই রইল রাজ্য আমার, শুধু তুমি আমার পাশে থেকো! সারা জীবনের জন্য থেকো। রাখাল বনধু কি তখন না থেকে পারে! রাজা তার বন্ধুকে নতুন সােনার বাশি গড়িয়ে দেন। রাখাল সারাদিন মন্ত্রীর কাজ করে, প্রজাদের দুঃখ সরিয়ে তাদের মুখে হাসি আনে। সারাদিনের কাজ শেষে রাজা বন্ধুকে নিয়ে যান। পুরানাে দিনের মতাে রাখালবন্ধু তখন বাঁশি বাজায়, আর রাজা সেই সুর শােনেন। সুখে রাজার মন ভরে ওঠে। 

প্রশ্নগুলাের উত্তর বলি ও লিখি। 
ক. রাজপুত্র কোথায় বসে রাখাল বন্ধুর বাঁশি শুনত? 
খ. রাজপুত্র রাখাল বন্ধুর কথা ভুলে যায় কেন? 
গ. রাজা কেন মনে করলেন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের কারণেই তার এই দশা? 
ঘ. তােমার মা বাড়িতে কী ধরনের পিঠা বানায় লেখ। 
ঙ. অচেনা লােকটি রাজার প্রাণ রক্ষার জন্য এগিয়ে না এলে কী হতাে?
 চ. তুমি কী মনে কর অচেনা লােকটির কারণেই রাজার প্রাণ রক্ষা পেল? 
ছ, কীভাবে লােকেরা নকল রানিকে বুঝে ফেলল? 
জ, রাজা কীভাবে তার প্রতিজ্ঞা পালন করলেন? 
ঝ. কাঞ্চনমালা এবং কঁাকনমালার চরিত্রের তুলনামূলক আলােচনা কর। 
ঞ. গল্পটা তােমার কেমন লেগেছে? বর্ণনা দাও। 


Post a Comment

0 Comments