উনিশ শ একাত্তর -ইমদাদুল হক মিলন


একদিন দুপুরবেলা দীনুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। একাত্তর সালের কথা। বর্ষাকাল ছিল সেদিন, টানা দশ দিন পর দীনুদের ছােট্ট মফস্বল শহরে দুপুরের দিকে রােদ উঠেছে। এক দিন ছিল বৃষ্টি। ঘাের বৃষ্টি। সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। আকাশ ছিল পােড়ামাটির চুলাের মতাে। থেকে থেকে মেঘ ডেকেছে, বিদ্যুৎ চমকেছে। আর বৃষ্টি। কেমন বৃষ্টি। শহরের চারদিকে ছিল বর্ষার জল। জলের ওপর মাইলকে মাইল ভেসে ছিল আমন ধান। ধানে তখন থােড় আসার সময়। বৃষ্টি ছিল, বাতাস ছিল না বলে বৃষ্টির তলায় ধানী মাঠগুলাে ছিল স্বপ্নের মতাে স্থির। সুবলদের বাড়িটা শূন্য পড়ে আছে অনেক দিন। বর্ষার মুখে সুবলরা বাড়ি ছেড়ে গেল। যাওয়ার দিন সকালবেলা সুবলের বুড়ি দিদিমা দীনুকে ডেকে বললেন, “আমরা চলে যাচ্ছি দীনু। তারপর আঁচলে চোখ মুছলেন। 

দীনু কিছু বুঝতে পারে না। দিদিমার চোখে জল দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তারপর টের পায় নিজের চোখও জলে ভরে আসছে তার। দীনু ছেলেটা এই রকম। কারও চোখের জল সইতে পারে না। জন্মের পর সে দেখেছে এই মফস্বল শহর, এই সব মানুষজন। জগৎ সংসারে তার আপন কেউ নেই বলে এই শহরের সবাই তার বড় আপন। কাউকে দীনু ডাকে বাবা, কাউকে মা, ভাইবােন, দিদিমা, জ্যাঠা, চাচা, মামা, খালা, পিসি-আত্মীয়ের অভাব নেই দীনুর। আর নিজের কোনাে বাড়িঘর নেই বলে এই শহরের সবগুলাে বাড়িঘরই দীনুর নিজের। যখন সে ইচ্ছে বাড়ি যায়। খিদে থাকলে সােজা গিয়ে ঢেকে রান্নাঘরে। ঘুম পেলে যে কোনাে বিছানায় ফাক ফোকর দিয়ে গুটিশুটি শুয়ে পড়ে। দীনুকে কেউ কখনাে ফেরায় না।

দীনুর বয়স দশ বছর। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে, মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ কখনাে ওর সঙ্গে রাগ করতে পারে না। দশ বছর বয়সে দীনুও যেন কেমন করে কথাটা জেনে গেছে। কিন্তু একটা কথাই দীনুর জানা হয়নি- দীনু হিন্দু না মুসলমানকেমন করে যে এই শহরে এসেছিল, কার কোলে কেউ তা জানে না। যদিও এ নিয়ে দীনুর কোনাে দুঃখ নেই। সুখ আছে। দশ বছরের জীবনেই দীনু জেনে গেছে মানুষের মধ্যে অনেক ভাগ। সে কোন ভাগে? দীনু জানে না। সুখটা এই। অবাধে সে হিন্দু বাড়ি যায়। মাসি পিসি ডাকে। পেটপুরে খায়, ঘুমায়। যায় মুসলমান বাড়ি । খালা ফুফু ডাকে। পেটপুরে খায় ঘুমায়। দীনুর কোনাে দুঃখ নেই। তাে সুবলের দিদিমা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “দীনুরে আমরা কলকাতা যাচ্ছি। 
‘কোথায় দিদিমা ?” 
কলকাতা। 

কলকাতা কোথায়, দীনু জানে না। তার মনে হয় এই শহরের আশপাশেই হবে কলকাতা, দিদিমারা বােধ হয় আত্মীয়-বাড়ি যাচ্ছে বেড়াতে। দু-পাঁচ দিন পর ফিরে আসবে। কিন্তু দিদিমা তাহলে কাদে কেন? দীনু তখন সারা বাড়ির লােকজনের মুখ দেখে। কেমন থমথমে দুঃখী মুখ সবার। আর কত যে বােচকা-বুচকি। খাট-পালঙ্ক আর ভারী জিনিসপত্র ছাড়া সবই নিয়ে যাচ্ছে সুবলরা। আত্মীয়-বাড়ি গেলে কেউ কি অত জিনিসপত্র নিয়ে যায়? দীনুর মাথার ভেতর বড় রকমের একটা গিঁট লেগে যায়। গিঁট খুলতে দীনু যায় সুবলের কাছে। সুবল দীনুর বয়সী। হলে হবে কী, সুবলটা বড় বুদ্ধিমান। স্কুলে পড়ে তাে।। ‘জানিস না দেশে গণ্ডগােল লেগেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কত মিলিটারি এসেছে। মিলিটারিরা সব মানুষ মেরে ফেলবে। ইয়া বড় বড় বন্দুক আছে। শুনে দীনু খুব ভয় পেয়ে যায়। হায় হায়, তাহলে! ‘তাহলে আর কি! আমরা তাে এ জন্যই চলে যাচ্ছি। তখন দীনু একটা আবদার করে বসে। সুবল আমাকে নিবি?” “যাঃ, তােকে কোথায় নেব।' 

এ কথা শুনে সুবলের দিদিমা এগিয়ে আসেন। তারপর আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে দীনুর মাথায় হাত রাখেন। ‘দীনু দাদারে, মন খারাপ করিসনে। ওখানে আমাদেরই কোনাে ঠাই-ঠিকানা নেই। থাকলে তােকে নিয়ে যেতাম। তারপর আবার আঁচলে চোখ ঢাকেন। দেখে দীনু এবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলে। দিদিমা বললেন, আমাদের এই বাড়িটা তােকে দিয়ে গেলাম। তাের তাে কোথাও থাকার জায়গা নেই। এখানে থাকিস। একা থাকতে ভয় লাগলে কাউকে নিয়ে থাকিস।ঘরে চাল-ডাল সব আছে। তাের ছয় মাস চলবে। আর শােন দাদু, তাের ভয় নেই। তুই খুব ভালাে ছেলে ! তােকে পাকিস্তানি সেনারা কিছু করবে না। দেশ স্বাধীন হলে আমরা ফিরে আসব।' 

‘দেশ স্বাধীন মানে? এত দুঃখের মধ্যেও সুবলের দিদিমা হেসে ফেলেন। এই দেশটা পূর্ব বাংলা, আর পূর্ব বাংলা থাকবে না। হবে বাংলাদেশ। দীনু হয়তাে আরও কিছু জিজ্ঞাসা করত। কিন্তু তার আগে খালপাড়ে বিরাট ছইওয়ালা নৌকা এসে ভিড়ল । বােচকা-বুচকি নিয়ে সুবলরা সব নৌকায় গিয়ে উঠল। দীনু গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল খালপাড়ে। তারপর যতক্ষণ সুবলদের নৌকা দেখা যায়, ততক্ষণ কতবার যে চোখের জল মুছল, গােনাগুনতি নেই। সেই দিনটা বড় খারাপ কেটেছে দীনুর। সারা দিন কিছু খায়নি। সুবলদের বাড়ির তিনটে ঘরের চাবিই দীনুকে দিয়ে গিয়েছিলেন সুবলের দিদিমা। কিন্তু দীনু শুধু খুলেছিল বাংলাঘরের তালা । 

সুবলদের বাংলাঘরে পুরােনাে কালের বিশাল একটা চৌকি পাতা। ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে। সেই চৌকিতে সারা দিন শুয়ে থেকেছে দীনু। জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে আকাশ দেখেছে। সুবলদের কথা ভেবেছে, আর মিলিটারিদের কথা। মিলিটারিরা সত্যি কি সব লােকজন মেরে ফেলবে তাহলে? এত ভাবতে ভাবতে দীনু ঘুমিয়ে পড়েছে কখন যে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দীনু খুব ভয় পেয়ে গেল। প্রথমে খানিকক্ষণ সে বুঝতে পারে না, কোথায় শুয়ে আছে। যখন বুঝতে পারল সুবলদের বাংলাঘরে-ভয়টা শুরু হলাে তখুনি। সুবলদের বাড়িতে বিশাল তিনটা ঘর। বাড়ির পেছনে ফলফলারির গহিন বাগান। একটা বাঁধানাে পুকুর। তার ওপর কাছে পিঠে কোনাে বাড়ি নেই। এই রকম একটা বাড়িতে দীনু একলা। সারা দিন কিছু খায়নি। তবুও খিদে টের পায় না। 

চোখ বন্ধ করে খােলা জানালার পাশে পড়ে থাকে দীনু। শেষরাতে একটুখানি চাঁদ উঠেছিল বলে, জানালা দিয়ে জ্যোত্সা এসে ঘরে ঢুকেছিল বলে রক্ষে। রাতটা দীনুর কেটে যায়। নয়তাে কী যে হতাে, দীনু হয় তাে সেদিন.... পরদিন বাজারে গিয়ে জমির চাচাকে ধরে দীনু। জমির বাজারের কোণে বসে ভিক্ষে করে। ভালাে মানুষ। তবুও লােকে বলে জমির পাগলা। দীনু ডাকে জমির চাচা। সেই জমির চাচাকে পটিয়ে এল দীনু। তােমার তাে কোথাও থাকার জায়গা নেই, আজ থেকে তুমি আমার সঙ্গে সুবলদের বাংলাঘরে থাকবে। সুবলরা কেউ বাড়ি নেই। 

আমি এখন সুবলদের বাড়ির মালিক। সুবলদের চলে যাওয়ার কথা, দেশে গণ্ডগােল, মিলিটারিদের কথা আর সুবলের দিদিমার মুখে শােনা স্বাধীনতার কথা সবই জমির চাচাকে বলে দীনু। জমির চাচা চমৎকার লােক। দীনুর কথায় রাজি না হয়ে কি পারে? সেই থেকে জমির চাচা আর দীনু দুজনে সুবলদের বাংলাঘরে থাকে রাতের বেলা । দিনের বেলাটা দীনুর কাটে এ বাড়ি-ও বাড়ি করে। জমির চাচা থাকে বাজারে। সুবলের দিদিমা বলে গিয়েছিলেন, ‘ঘরে চাল ডাল সব আছে। রান্না করে খাস দীনু। তাের ছয় মাস যাবে।' কিন্তু দীনু বড় ঘরটা খােলেনি। দীনু রান্না করতে জানে না। চাল-ডাল তেমনি আছে। আজ দুই মাস। কিন্তু আজই আবার দীনুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। 

দুপুরের দিকে দশ দিন পরে রােদ উঠেছে দেখে দীনুর খুব ফুর্তি। লাফাতে লাফাতে গেছে খােকনদের বাড়ি। খােকনকে নিয়ে আজ খালের জলে খুব সাঁতার কাটবে ভেবেছে। কিন্তু খােকনদের বাড়ি গিয়েই মনটা খারাপ হয়ে গেল। খােকনদের বাড়িতে কেমন একটা সাজ সাজ রব। খােকনের সব ভাইবোেন জামাকাপড় পরে ছুটোছুটি করছে। খােকনের মা এদিক ওদিক ঘােরাফেরা করছেন, একে এক কথা বলছেন ওকে আরেক কথা। খােকনদের বাড়ির সঙ্গেই খাল, সেখানে একটা বড় ছইঅলা নৌকা বাঁধা। মাঝিরা খােকনদের সৰ বােচকা-বুচকি নৌকায় তুলছে। কী ব্যাপার, খােকনেরা সব যায় কোথা? দীনু অবাক হয়ে খােকনের মাকে জিজ্ঞেস করে, “খালা, কোথায় যাচ্ছ তােমরা? খােকনের মা দুঃখী গলায় বললেন, 'বকুলতলী যাচ্ছিরে দীনু। আমার বড় ভাইয়ের বাড়ি। 

‘কেন? “ওমা তুই জানিস না, শহরে মিলিটারি এসে গেছে। সবাই শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। মিলিটারি সব লােকজন মেরে ফেলবে। দীনু ভয় পেয়ে বলল, “তাই নাকি, কবে এসেছে? ‘কাল সন্ধ্যায়! হাই স্কুলে ক্যাম্প করেছে। বৃষ্টি-বাদলা ছিল বলে বেরােয়নি। আজ রােদ উঠেছে, দেখবি খানিক বাদেই বেরুবে। তারপর যাকে পাবে তাকেই মারবে। তুইও চলে যা কোথাও। দীনু অবাক হয়ে বলল ‘আমি কোথায় যাব? এই শহরের বাইরে আমার কোনাে চেনা মানুষ নেই। কার কাছে যাব।' খােকনের মা একটু রাগী। এই শহরে এই একজন মানুষ, দীনু যাকে খুব ভয় পায়। তবুও এই মুহূর্তে সাহস করে বলল, খালা, আমাকে তােমাদের সঙ্গে নেবে? 

‘কোথায়? বকুলতলী। শুনে খােকনের মা একটু গম্ভীর হয়ে যান। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, বাবা দীনু, আমার ভাই খুব গরিব মানুষ। বাড়িতে একটা ঘর। তার বড় সংসার, ঘরে জায়গা হয় না। তার ওপর আমরা এতগুলাে লােক। কোথায় থাকব, কেমন করে থাকব জানি না। এই অবস্থায় তােকে কেমন করে নেব বাপ। খােকনের মা আঁচলে চোখ মােছেন। দেখে দীনুরও চোখ ভরে আসে জলে। 

খােকনের মা দীনুর মাথায় হাত রাখেন। মন খারাপ করিস নে বাপ। আমি দোয়া করি, তাের কিছু হবে না। এত সুন্দর ছেলে তুই, এত ভালাে। তার গায়ে কেউ হাত দেবে না।' তারপর নৌকায় গিয়ে ওঠেন। খােকনেরা সব আগেই নৌকায় উঠে বসেছিল, মা ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মাঝিরা বৈঠা ফেলল খালের জলে। বিষঃ দীনু মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল খালপাড়ে সাদা বেলে মাটির ওপর। তখন সেই মফস্বল শহরে চমক্কার রােদ। চারদিকের শূন্য বাড়িঘর রােদের আলােয় ঝকমক করছে। খালের জলে, বর্ষার ধানী মাঠে রােদ আর হাওয়ার খেলা। কাছে কোথাও কোনাে ধানী মাঠের ভেতর নেমেছে কোড়া পাখি। তার কুরকুর একটানা ডাক শােনা যায়। 

খালপাড়ে দাঁড়িয়ে দীনু ভাবে- সবারই কোথাও না কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে। কেবল তার নেই। বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে দীনুর। তারপর মন খারাপ করে খালপাড় ধরে একাকি হাঁটতে থাকে। কোথাও কোনাে লােকজনের চিহ্ন নেই, সাড়া নেই। দিনের বেলাটাকে মনে হয় রাত দুপুর। সবাই ঘুমুচ্ছে। কিন্তু দীনু এখন কোথায় যাবে? তখন জমির চাচার কথা মনে পড়ে দীনুর। জমির চাচা সকালবেলা বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে গেছে। এখন নিশ্চয়ই বাজারের কোণে বসে ভিক্ষা করছে। দীনু ভাবে, জমির চাচাকে গিয়ে মিলিটারির কথা বলবে। তারপর জমির চাচার সঙ্গে কোথাও চলে যাব। জমির চাচার নিশ্চয় কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে। 

আর জমির চাচা যদি যায়, দীনুকে ফেলে যেতে পারবে না। কিন্তু তারপরই দীনুর মনে হয়, শহরের কোথাও কোনাে লােক নেই আজ। বাজার কী বসেছে? সবাই পালালে দোকানিরাও পালাবে। আর দোকানিরা পালালে জমির চাচাও পালাবে। কিন্তু দীনুকে ফেলে কি জমির চাচা পালাতে পারে? দুই মাস ধরে একসঙ্গে আছে। দীনুর মাথার ভেতর ছােটখাটো একটা গিট লেগে যায়।। খালের ওপারেই হাই স্কুল। জমির চাচার কথা ভাবতে ভাবতে স্কুলের কাছাকাছি এসে গেছে, তখন ঠিক তখনি মিলিটারির মধ্যে একজন তার নিশানা ঠিক আছে কি না দেখার জন্য খালের ওপার থেকে দীনুকে তাক করে। অটোমেটিক রাইফেলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দীনু দেখে একের পর এক আগুনের মৌমাছি ছুটে আসছে তার দিকে। আর মাথার ওপর সারা শহরের কাক কা কা করছে। দুই হাতে বুক চেপে ধরে দীনু। দেখে দশ আঙ্গুলের ফাঁকফোকড় দিয়ে জোয়ারের জলের মতাে নেমে যাচ্ছে। রক্ত। খালপাড়ের সাদা মাটি লাল হয়ে যাচ্ছে। আস্তে-ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দীনু। 

চোখ দুটো ভীষণ টানছিল তার। তখুনি দৃশ্যটা দেখতে পায় ও। তার বুকের রক্তে তৈরি হয়েছে বিশাল লম্বা এক খাল। সেই খাল বেয়ে ফিরে আসছে হাজার হাজার ছইঅলা নৌকা। প্রথম নৌকায় সুবলরা। সুবলের বুড়ি দিদিমা বসে আছেন ছইয়ের ভেতর। তার পেছনের নৌকায় খােকনরা। প্রতিটি নৌকা থেকে ভেসে আসছে উল্লাসের শব্দ। দেখে দীনুর যে কী খুশি! সবাই ফিরে আসছে। তাহলে এই 
কি স্বাধীনতা! সুবলের দিদিমা বলেছিলেন। ও স্বাধীনতার কথা ভেবে দীনুর ঠোটে বাংলাদেশের মানচিত্রের মতাে সুন্দর এক টুকরাে হাসি ফুটেছিল। কেউ তা দেখেনি।

লেখক-পরিচিতি বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। তিনি ১৯৫৫ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গিয়াস উদ্দিন খান এবং মাতার নাম আনােয়ারা বেগম। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার পাশা গ্রামে।  
করেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে। তার প্রথম গল্প প্রকাশিত ১৯৭৩ সালে। গল্পের নাম ছিল বন্ধ। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ১৪০। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে :নূরজাহান, পরাধীনতা, পরবাস, ভূমিপুত্র, কালােঘঘাড়া, নিরন্নের কাল, দেশভাগের পর ইত্যাদি। তিনি ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেন।

পাঠ-পরিচিতি মফস্বল শহরে বাস করে অনাথ দীনু। সে হিন্দু না মুসলমান সে কথা জানে না। কেমন করে এই শহরে এসেছে। তাও সে জানে না। তার বাবা-মা কে, তাদের পরিচয় কী, কিছুই তার জানা নেই। দীনুর বয়স দশ বছর। তার মুখ ও চোখ দুটো খুব সুন্দর। পৃথিবীতে তার আপন কেউ নেই বলে শহরের সবাই তাকে ভালােবাসে এবং আদর করে।

শহরের সব বাড়িতে দীনুর অবাধ যাতায়াত | সে কাউকে বাবা ডাকে, কাউকে ডাকে মা। এই শহরে ভাইবােন, দিদিমা, জ্যাঠা, চাচা, মামা, খালা, পিসি ইত্যাদি আত্মীয়ের অভাব নেই তার। ঘুম পেলে যে কোনাে বাড়ির বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। দীনুকে কেউ বাধা দেয় না। 

উনিশ শ একাত্তর সালের বর্ষাকালে এক দুপুরবেলা। টানা দশ দিন বৃষ্টির পর রােদ উঠেছে। ইতােমধ্যে সুবলরা পরিবারের সবাইকে নিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারিদের ভয়ে চলে গেছে কলকাতায়। যাওয়ার সময় সুবলের দিদিমা দীনুকে তাদের শূন্য ঘরে থাকতে বলে গেছেন। দীনু সুবলদের সাথে কলকাতায় যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দিদিমা দীনুকে সাথে নেয়নি। কারণ ওখানে ওদেরই ঠিকমতাে থাকার বন্দোবস্ত নেই। সুবলরা কলকাতা চলে যাওয়ার পর দীনু তাদের শূন্য ঘরে গিয়ে থাকে। 

একা থাকতে ভয় লাগে বলে জমির চাচা আর দীনু দুজনে রাতের বেলা থাকে। দীনু জমির চাচার কাছে বলে সুবলদের চলে যাওয়ার কথা, মিলিটারিদের কথা এবং সুবলের দিদিমার মুখে শােনা স্বাধীনতার কথা। রােদ উঠার পর দীনু গিয়েছিল খােকনদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখে থােকনরা সবাই মিলিটারিদের ভয়ে একসাথে তার বড় মামার বাড়ি বকুলতলী চলে যাচ্ছে। দীনু ওদের সাথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু খােকনের মা নিতে সম্মত হননি।

খােকনরা মিলিটারিদের ভয়ে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। দীনুর যাওয়ার কোনাে জায়গা নেই বলে সে শহরেই থাকে। থােকনরা বড় নৌকায় করে চলে যায়। দীনু খালের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে সবারই কোথাও না কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে। অথচ তার কোনাে জায়গা নেই। বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে দীনুর। সে জমির চাচার খোঁজে চলে যায় বাজারে। দীনু দেখে, শহরে কোথাও কোনাে মানুষ নেই। সবাই ভয়ে পালিয়েছে। দীনু জমির চাচার কথা ভাবতে ভাবতে হাইকলের কাছাকাছি আসে। ঠিক তখনই মিলিটারিদের একজন নিশানা ঠিক আছে কি না দেখার জন্য খালের ওপার থেকে দীনুকে তাক করে। গুলিবিদ্ধ দীনু মারা যায়। মৃত্যুর পূর্বে সে দেখে তার রক্তের খাল দিয়ে সুবল ও খােকনরা ফিরে আসছে আনন্দের সাথে সাথে এসেছে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। 


শব্দার্থ ও টীকা একাত্তর সাল- উনিশ শ একাত্তর সাল, যে বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ হয়েছিল। মফস্বল শহর ছােট শহর। পােড়ামাটির চুলাে- মাটির চুলা পুড়ে যেমন কালাে হয়ে যায়; মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ছিল তেমনি কালাে। আমন ধান-হেমন্তকালীন ধান; বা এক বিশেষ রকমের ধান। থােড়- ফুল বের হওয়ার পূর্বে ধান গাছের ডগা মােটা হয়। এই অবস্থার নাম থােড়। ধানী মাঠ- যে মাঠ ধানে ভরা। স্বপ্নের মতাে স্থির- স্বপ্ন যেমন চলাচল করে না তেমন। ভ্যাবাচ্যাকা- বােকা বনে যাওয়া। জগৎ সংসারে- পৃথিবীতে। গুটিশুটি জড়ােসড়াে। অবাধে বিনা বাধায়। পেট পুরে পেট ভরে। কলকাতা- ভারতবর্ষের পশ্চিম বাংলা রাজ্যের রাজধানী শহর। উনিশ শ একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু বাঙালি এই শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। থমথমে গভীর। বােচকা-বুচকি- কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্রের বান্ডিল। পালঙ্ক- দামি ও নকশা করা খাট। গিট- বাঁধন বা জটিল। পশ্চিম পাকিস্তান - ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। এক অংশের নাম হয় পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ- একটি অংশের নাম পশ্চিম পাকিস্তান। অন্যটি পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। মিলিটারি সেনাবাহিনী। আবদার বায়না বা অদ্ভুত দাবি। ঠাই-ঠিকানা-থাকার জায়গা। স্বাধীন- নিজের অধীন; পরাধীনতা মুক্ত হওয়া। পূর্ববাংলা- অখণ্ড বাংলার পূর্ব অংশ। গােনাগুনতি হিসাব-নিকাশ। বাংলাঘর- বৈঠকঘর। ফলফলারি- বিভিন্ন ধরনের ফল। গহিন গভীর। বাঁধানাে পুকুর- যে পুকুরের ঘাট বাঁধানাে থাকে। ক্যামপ- সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ঘাঁটি। বড় সংসার- অনেক সদস্যের পরিবার। বিষন্ন- দুঃখিত স্নান। কোড়া পাখি- বিশেষ ধরনের পাখি। কুরকুর- কোড়া পাখির ডাক। বুক কাঁপিয়ে গভীর কষ্টে। নিশানা দিক নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা। তাক লক্ষ্য করা। অটোমেটিক রাইফেল- স্বয়ংক্রিয় বন্দুক। আগুনের মৌমাছি- বন্দুকের গুলি। লম্বা- দীর্ঘ। উল্লাস- আনন্দ আহ্লাদ। 

সৃজনশীল প্রশ্ন ১৯৭১ সনের মে মাসের মাঝামাঝি এক বিকেলে আকুয়া প্রাইমারি স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ালাে জলপাই রঙের তিনটি ট্রাক। বুট পায়ে লাফিয়ে নেমে এলাে পাকিস্তানি আর্মি আর দখল করে নিয়ে ঘাঁটি বানিয়ে ফেললাে স্কুল ঘরটাকে দলবল নিয়ে স্কুল মাঠে খেলছিল এই স্কুলের ছাত্র সাত বছরের শ্যামল । আর্মি দেখে আড়ালে লুকিয়ে গেল সবাই। 
ক. খােকনরা কোথায় চলে গেল? 
খ. সুবল কলকাতা যাচ্ছে কেন? 
গ. উদ্দীপক উনিশ শ একাত্তর’ গল্পের যে বিষয়টুকু ধারণ করেছে তা বর্ণনা কর। 
ঘ, দীনু উনিশ শ একাত্তর’ গল্পের প্রাণ আর উদ্দীপকে শ্যামল তার একটি কণামাত্র কীভাবে? ব্যাখ্যা কর। 

Post a Comment

0 Comments