অলক্ষুণে জুতাে -মােহাম্মদ নাসির আলী


অনেক কাল আগের কথা। আলী আবু আম্মুরী নামে একজন ধনীলােক বাস করত বাগদাদ শহরে। শহরের ওপরে তার যেমন ছিল একখানা চমক্কার বাড়ি, তেমনি ছিল যথেষ্ট টাকা-পয়সা। শহরে সবাই তাকে ধনী বলে জানত। কিন্তু বিদেশি কেউ হঠাৎ এসে তার জামা কাপড় দেখে মােটেই ধারণা করতে পারত না যে, লােকটা সত্যিই ধনী। তার পাড়া পড়শিরা প্রায়ই বলাবলি করত; আলী আবু ধনী হবে না কেন? লােকটা নিজের জন্য একটি দিনারও ব্যয় করে না। চেয়ে দ্যাখাে একবার ওর জুতােজোড়ার দিকে, তাহলেই বুঝতে পারবে ও ধনী হয়েছে কী করে। বলেই তারা হাসতে থাকত।

আলী আবুর পায়ের নাগরাই জুতাে নিয়ে বাগদাদ শহরের শিশুরা অবধি হাসাহাসি করে। হাসবে না-ই বা কেন? এমন একজোড়া পুরােনাে জুতাে সারা বাগদাদ শহরে কেউ খুঁজে পাবে না। কেউ কেউ বলে, ও একজোড়া জুতাে পরে আলী আবু জিন্দেগি কাবার করে দিয়েছে। কিন্তু একজোড়া জুতাে কী করে এত দিন টিকতে পারে? হ্যা, আলী আবুর জুতাের কোনাে জায়গায় একটি ফুটো হলেই সে বেরােয় মুচির সন্ধানে। 

বাগদাদের মুচিরাও তাকে চিনে ফেলেছে। তাকে দেখলেই তারা বলে ওঠে, ওতে আর তালি লাগানাে চলবে না সাহেব, ওটা বাদ দিয়ে একজোড়া নতুন জুতাে কিনুন। আলী আবু কিন্তু সে কথায় কান দেয় না। সে আরেক মুচির কাছে যায়। এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে কেউ হয়তাে একটা তালি লাগিয়ে দেয়। এমনি করে আলী আবুর নাগরাই জুতাে সবার পরিচিত হয়ে উঠল। এমনকি বন্দুরা একে অপরকে বলতে লাগল, আলী আবুর নাগরাই জুতাের মতাে তােমার পরমায়ু হােক। কিন্তু অবশেষে সেই বিখ্যাত জুতােই আলী আবুর দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে উঠল। 

শহরের রাস্তায় বেরিয়ে একদিন সে যাচ্ছিল এক কাচের শিশি-বােতলের দোকানের পাশ দিয়ে। দোকানি তাকে দেখে বলে উঠল, এই যে আবু ভাই, আপনার জন্য একটা খােশখবর আছে। বিদেশি এক সওদাগর এসেছে, অনেকগুলাে আতরের শিশি বেচতে। চমকার রঙিন ফুলকাটা শিশি। মােটে ৫০ দিনার দাম। কিনে এক মাস ঘরে রাখলে তার দাম কম-সে-কম ১০০ দিনার দিয়েই আমি নেব। আমার বদনসিব যে এখন একটি দিনারও হাতে নেই। অমন লাভের লােভ কে সামলাতে পারে, সামলানাে সহজ ব্যাপার নয়। আলী আবুর রাত-দিন চিন্তাই হচ্ছে, কী করে টাকা বাড়ানাে যায়। কাজেই সে তৎক্ষণাৎ রঙিন শিশিগুলাে কিনে বাড়ি নিয়ে গেল।

দিনকয়েক পরে আরেক বন্ধু এসে খবর দিল, একটা লােক এসেছে বসরাই গােলাপজল বেচতে! চমক্কার জিনিস কিন্তু দাম একেবারে সতা। কিছুদিন পরেই এর দাম দুই গুণ-তিন গুণ হতে বাধ্য। আর তােমার সেই রঙিন শিশি ভর্তি করে বেচলে, চাই কি চার গুণও পেতে পার। আহা কী গােলাপ। টাকা বাড়ানাের কী অমূল্য সুযােগ। যােগাযযাগটা চমক্কার-রঙিন শিশি, তাতে গােলাপজল। আলী আবু ৫০ দিনার দিয়ে গােলাপজল কিনে নিয়ে এলাে। শিশিগুলাে গােলাপজলে ভর্তি করে সে যত্ন করে রেখে দিল জানালা বরাবর একটা তাকের ওপর। শিশি-বােতল রাখার পক্ষে এই জায়গাটাই তার বাড়িতে সবচেয়ে নিরাপদ। অল্প কয়েক দিনের ভেতর দু-দুটো লাভের কারবার করতে পেরে আলী আবুর মন খুশিতে আটখানা। সেদিন দুপুরবেলা সে শহরের হাম্মামে গিয়ে ঢুকল গােসল করতে। ঠিক সে সময়ে হাম্মাম থেকে গােসল সেরে বেরিয়ে আসছিল ওমর বিন আদি নামে তার এক বন্ধু। আলী আবুকে দেখেই সে বলে উঠল, আস্সালামু আলাইকুম, আবু ভাই। 

আলী আবু সাথে সাথে জবাব দিল। এমন সময় ওমরের নজর পড়ল আবুর জুতাের ওপর। ধনী বন্ধুর জুতাের এ দুর্দশা দেখে সে মাথা নেড়ে বলল, ভাই আলী আবু, তােমার তাে মা-শাল্লাহ টাকা-পয়সার কমতি নেই। একজোড়া নতুন জুতাে কেন তুমি কিছু না ভাই? সারাটা বাগদাদ শহর খুঁজেও তােমার নাগরাই জুতাের শামিল আর একজোড়া জুতাে কেউ বের করতে পারবে না। সত্যি বলছি, তােমার এ জুতােকে এবার পেনশন ৪ দিয়ে একজোড়া নতুন জুতাের ব্যবস্থা করা উচিত। 

এই বলে ওমর বিন আদি মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেল। আৰু কোনাে জবাব না দিয়ে শুধু মুচকি হাসল। গােসল সেরে কাপড়-জামা পরে আবু বাইরে এসে দেখল, তার জুতােজোড়া জায়গামতাে রাখা নেই। আসলে লােকের পায়ের ধাক্কায় দূরে এক বেঞ্চির তলায় দুখানা জুতাে দুপাশে পড়ে আছে। আবুর পুরােনাে জুতাে যেখানে ছিল, সেখানে পড়ে আছে একজোড়া দামি চকচকে নতুন জুতাে। চমৎকার জুতাে, তাও ঠিক আবুর পায়ের মাপের। আবু তখন মনে মনে ভাবল, আমার বন্ধু ওমরেরই এ কাজ। সে-ই নতুন জুতােজোড়া কিনে আমাকে উপহার দিয়ে গেছে। এ জন্যই মাথা নাড়ছিল ওমর। প্রাণ খুলে বন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবু নতুন জুতাে পায়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। আসলে আবুর অনুমান কিন্তু মােটেই সত্য নয়। জুতােজোড়া ছিল শহরের কাজির। 

আবুর মতাে তিনিও জুতাে ছেড়ে হাম্মামে ঢুকেছিলেন গােসল করার জন্য। বাইরে এসে কাপড় পালটাতে গিয়ে তিনি দেখলেন, জুতাে নেই সেখানে। দেখেই তিনি চিল্কার করে উঠলেন, আমার জুতাে কী হলাে? কাজির জুতাে নিখোঁজ ? খোঁজ খোঁজ সাড়া পড়ে গেল তক্ষুনি। চারদিকে খুঁজে পেতে অবশেষে পাওয়া গেল আলী আবুর রঙবেরঙের তালিওয়ালা সেই নাগরাই জোড়া। সেই জুতাে চিনতে কারও বাকি রইল না। তালিওয়ালা সেই জুতাে বাগদাদ শহরের কে না চেনে? এ জুতাে সেই কমবখত আলী আবুর না হয়ে যায় না। আমার নতুন জুতাে নিয়ে সে-ই পালিয়েছে। হাতেনাতে এভাবে না ধরলে কে ভাবতে পারে যে, ব্যাটা জুতােচোর? ব্যাটাকে ধরে এনে আচ্ছা সাজা দিতে হবে আজ। 

-- বলে কাজি চিৎকার করতে লাগলেন। তারপর লােকজনদের ডেকে পুরােনাে জুতাে পাঠিয়ে দিলেন আলী আবুর বাড়িতে। তারা গিয়ে দেখতে পেল, সত্যি সত্যি আলী আবুর পায়ে কাজির সেই নতুন জুতাে। আর যায় কোথায়? টানতে টানতে তারা বেচারা আলী আবুকে হাজির করল কাজির দরবারে। কাজি রেগে বললেন, এক্ষুণি ওর পিঠে দশ দোররা মারাে। মেরে নিয়ে যাও কয়েদখানায়। হাজার দিনার জরিমানা দিলে তবে ওর মুক্তি ।। 

ব্যাপারটা যে ভুলবশত হয়ে গেছে আবু তা বােঝাতে বারবার চেষ্টা করল। কিন্তু কে শুনবে তখন তার কথা। অবশেষে কেবল এক হাজার দিনার জরিমানা দিয়ে আলী আবু সে যাত্রা রক্ষা পেল। বাড়ি ফিরে আসতে আসতে সে ভাবল, যে অপয়া জুততার জন্য এতটা হয়রানি আর বেইজ্জতি, তার মুখ আর জীবনে দেখতে চাইনে। আজ বাড়ি গিয়ে ও-দুটোকে শেষ করতে হবে। এই ভেবে আৰু বাড়ি ফিরে তার নাগরাই জোড়া নিয়ে এল নদীর তীরে। তারপর বাড়ি থেকে বেশ খানিক দূরে একটা পুলের ওপর দাঁড়িয়ে এক এক করে দু-পাটি জুতােই ছুড়ে ফেলল নদীতে। কিন্তু সেদিন বিকেলে ঘটল এক কাণ্ড। এক জেলে এসে নদীতে জাল ফেলতেই মাছের পরিবর্তে সশরীরে উঠে এল আবুর সেই বিখ্যাত নাগরাই জোড়া। হরেক রকমের চামড়ার তালি লাগানাে জুতাে চিনতে জেলের দেরি হলাে না। সেবারের খ্যাপে জালে মাছ না উঠলেও সে কিন্তু মনে মনে খুশিই হলাে। বাড়ি ফিরে বউকে বলল, আলী আবু ধনী মানুষ- এতদিনের জুতােজোড়া ফেরত পেলে কম করেও দু-দিনার বকশিশ নিশ্চয় দেবে। দুঃখের বিষয়, জেলে যখন আলী আবুর বাড়ি জুতাে নিয়ে হাজির হলাে, তখন বাড়িতে কেউ ছিল না। ঘরের দরজাগুলাে সব বন্ধ। শুধু একটা জানালা খােলা ছিল। তাও ছিল অনেক উঁচুতে। জেলে মনে মনে বলল, এই নিয়ে আর তকলিফ করে ফিরে যাওয়া যাবে না। তার চেয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে দিলেই আবু এসে তার জুতাে পেয়ে খুশি হবে। পরে যখন দেখা হবে, তখন বললেই হবে যে, আমি পেয়েছিলাম ওটা। বকশিশটাও তখন চেয়ে নেওয়া যাবে। এই বলে জানালা দিয়ে জুতাে দু-খানা ছুড়ে মারতেই সেগুলাে গিয়ে পড়ল গােলাপজলের শিশির ওপর। তার ফলে তাকের সবগুলাে শিশি মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। রাতে বাড়ি ফিরে আবুর তাে চক্ষু চড়কগাছ। মাথা চাপড়ে সে কেঁদে উঠল। আবার সেই অপয়া জুতাের কীর্তি। কী বদনসিবই হয়েছে আমার। আজই, এক্ষুণিই, এ অলক্ষুণে জুতাের হাত থেকে যে করেই হােক রেহাই পেতে হবে। এই বলে বাগানের একপাশে দেয়ালের ধারে গিয়ে সে মাটি খুঁড়তে লাগল। আঁধারে তখন কিছুই দেখা যায় । 

কিন্তু কাল ভাের অবধি অপেক্ষা করার মতাে মনের অবস্থা আবুর মােটেই নেই। চোর যেমন আঁধারে সিঁধ কাটে আবুও তেমনি আঁধারেই মাটি খুঁড়তে লাগল। দেয়ালের পাশে শব্দ শুনে পাশের বাড়ির লােকেরা এল আলাে নিয়ে। এসে দেখল আবুর কাণ্ড। তারা বলল, এই তােমার কীর্তি! আঁধারে বসে দেয়ালের তলায় সুড়ঙ্গ কেটে আমাদের সর্বৰ্ষ চুরি করার মতলব? চল এক্ষুণি কাজির কাছে। এবার কাজি তাকে দেখেই বলে উঠলেন, আবার চুরি! কদিন আগে আমার জুতাে চুরি করে জরিমানা দিয়েছ। এবার বুঝি বড় রকমের দাও মারবার মতলবে ছিলে? এই বলে আবুকে কথা বলার সুযােগ না দিয়েই কাজি তাকে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দিলেন। বাড়ি এসে সে ভাবল-দু-বার দুই হাজার দিনার জরিমানা দিয়ে জেল খাটার হাত থেকে রেহাই পেলাম। কিন্তু জুততার হাত থেকে রেহাই না পেলে চলবে না। এই অলক্ষুণে জুতাে বাড়ির বার করতেই হবে। অনেক ভেবেচিন্তে এবার সে জুতােজোড়া ফেলে এল নর্দমায়। বাড়ি ফিরে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল, এতদিনে সত্যিই রেহাই পেলাম । নর্দমায় কেউ জাল ফেলতে আসবে না। পরের দিন ভােরে ঝাড়দার এল নর্দমা পরিষ্কার করতে। এসে দেখল একজোড়া ছেড়া জুতাে আটকে নর্দমা বন্ধ হয়ে আছে। বলা বাহুল্য, জুততার মালিককে চিনতে বেগ পেতে হলাে না। ময়লা জুতােজোড়া সে আবুর বাড়ির দরজায় রেখে চলে গেল। 
আবুর ঘুম ভাঙতে বাইরে এসে দেখল, আবার সেই জুতাে। আবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। এবার কী করবে তাই বসে সে ভাবতে লাগল। 

রাস্তা দিয়ে এক কুকুর যাচ্ছিল ছুটে। হঠাৎ আবুর বাড়ির কাছে এসেই থেমে পড়ল। তারপর মাটি শুকতে পুঁকতে এগিয়ে এল জুতাের কাছে। এসেই একপাটি জুতাে মুখে নিয়ে দে-ছুট। অগত্যা আবুও ছুটল কুকুরকে তাড়া করে। ছুটতে ছুটতে সামনে পড়ল একটা দেয়াল। কুকর দেয়াল টপকে যেতেই জুতােটা ফসকে গিয়ে পড়ল দেয়ালের ওপাশে একটা ছােট ছেলের মাথায়। আবুর ভারী জুতাের ঘায়ে ছেলে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। বাড়িতে হইচই পড়ে গেল। সবাই এল ছুটে।। তারপর আবার সেই কাজির দরবার। আবুকে দেখে কাজি রেগে উঠে বললেন, ছেলেটার চিকিৎসার সব টাকা তাে দিতেই হবে, তা ছাড়া সমপরিমাণ টাকা খেসারতও দিতে হবে। বেচারা এবার কেঁদেই ফেলল। দুবার জরিমানা আর শিশির কারবারে লােকসান দিয়ে আবুর হাতে নগদ টাকা পয়সা কিছুই ছিল না। তাই এবার তাকে ধাক্কা সামলাতে হলাে বন্ধুবান্ধবের কাছে ধার করে। এ ঘটনার দিন-দুই পরে আবু এসে হাজির হলাে কাজির দরবারে। কাজি তাে তাকে দেখেই অবাক। সেদিকে লক্ষ না করে তালি দেওয়া জুতােজোড়া কাজির সামনে রেখে আবু বলল, এবার আমার ফরিয়াদ রাখতে হবে হুজুর। আমার এই জুতােজোড়ার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ। এ অলক্ষুণে জুতাের কারণে আমার যা কিছু দুর্ভোগ ঘটেছে, তা শুনে হক ইনসাফ করুন, করে দোষীর সাজা দিন। 

কাজি অবাক হয়ে চেয়ে রইল। লােকটা তামাশা করছে না কি! আবু আবার বলতে লাগল, আমি সত্যি বলছি হুজুর। আমার বুড়ােবয়সে সবকিছু দুর্ভোগের মূল ওই ছেড়া জুতােজোড়া। এ দুটোকে এমনভাবে কয়েদ করে রাখুন যাতে আমার নজরে আর না পড়ে। এই বলে সে একে একে কাজিকে সব কথা খুলে বলল। আবুর দুর্ভোগের কথা শুনে কাজির ভীষণ হাসি পেল। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, সত্যিই তুমি জুতাের বদৌলতে কষ্ট ভােগ করছ দেখতে পাচিছ। যাও তােমার জরিমানার টাকা সৰ ফেরত দেওয়ার হুকুম দিলাম। তা ছাড়া এ জুতাে আর তােমাকে দেখতে হবে না। কাজি সত্যিই দয়ালু ছিলেন। তিনি আবুর দুই হাজার দিনার সাথে সাথে ফেরত দিয়ে দিলেন। জুতােজোড়ার ভাগ্যে কী ঘটেছিল কেউ বলতে পারে না। কিন্তু আবুর পায়ে সেগুলােকে আর দেখা যায়নি।

লেখক-পরিচিতি ১৯১০ সালের ১০ই জানুয়ারি মােহাম্মদ নাসির আলী ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের ধাইদা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হায়দার আলী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি তেলিরবাগ কালীমােহন-দুর্গামােহন ইনস্টিটিউট থেকে এন্ট্রান্স (১৯২৬) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম (১৯৩১) পাস করেন। তারপর চাকরির সন্ধানে কলকাতায় যান। ১৯৩৩ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে অনুবাদক হিসেবে যােগদান করেন। পরবর্তীকালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার শিশু বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। পাকিতান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকায় এসে হাইকোর্টের চাকরিতে যোেগদান করেন এবং ১৯৬৭ সালে অবসরে যান। অবশ্য এর আগেই ১৯৪৯ সালে তিনি নওরােজ কিতাবিস্তান নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন এবং পুস্তক ব্যবসা চালিয়ে যান। ১৯৫২ সালে দৈনিক আজাদের শিশু-কিশাের বিভাগে ‘মুকুলের মাহফিল পরিচালনা করেন এবং বাগবান ছদ্মনামে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ঐ দায়িত্ব পালন করেন। শিশুতােষ গ্রনপ্রণেতা হিসেবেই নাসির আলীর মুখ্য পরিচয়। তবে তিনি শিক্ষামূলক গল্প, প্রবন্ধ ও জীবনীও রচনা করেন। নির্মল হাস্যরস সৃষ্টিতে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলাে হলাে : 'মণিকণিকা (১৯৪৯), শাহী দিনের কাহিনী (১৯৪৯), ‘ছােটদের ওমর ফারুক (১৯৫১), 'আকাশ যারা কালাে জয়’ (১৯৭৫), ‘আলী বাবা’ (১৯৫৮), ‘ইতালীর জনক গ্যারিবল্ডি’ (১৯৬৩), বীরবলের খােশ গল্প’ (১৯৬৪), ‘সাত পাঁচ গল্প’ (১৯৬৫), ‘বােকা বকাই (১৯৬৬), “যােগাযােগ’ (১৯৬৮), ‘লেবু মামার সপ্তকাণ্ড’ (১৯৬৮) ইত্যাদি। সাহিত্যের জন্য তিনি ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। ১৯৭৫ সালের ৩০শে জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

সার-সংক্ষেপ - অনেক দিন আগে আলী আবু আম্মুরী নামে এক ধনীলােক বাগদাদ শহরে বাস করত। কিন্তু সে খুবই সাধারণ পােশাক পরত। সে তার জুতাজোড়া দীর্ঘদিন ধরে জোড়াতালি দিয়ে ব্যবহার করত। ফলে তার ব্যবহৃত জুতাজোড়া সবাই চিনত। সবার চেনা এই জুতাজোড়াই কাল হলাে তার। একবার ভুল করে জুতা চুরির দায়ে তাকে জরিমানা দিতে হয়। রাগে-দুঃখে তা নদীতে ফেলে দিলে জেলে তার জালে জুতাগুলাে পায়। যেহেতু আবুর জুতা প্রায় সবাই চিনত, কাজেই সেও চিনল। ফেরত দিতে গিয়ে সে বাড়িতে কাউকে না পেয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারে ঘরের ভেতর। এতে আবুর ব্যবসার জন্য রাখা গােলাপজলের শিশি-বােতল ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। আবার এ জুতা মাটিতে পুঁতে ফেলতে গেলে সিধেল চোর হিসেবে ধরা পড়ে জরিমানা দিতে হয়। নর্দমায় ফেলে দিলে ঝাড়ুদার তা এনে বাড়ির দরজার সামনে রেখে যায়। কুকুর একপাটি জুতা নিয়ে পালিয়ে গেলে তা এক ছেলের মাথায় পড়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এতেও তাকে জরিমানা দিতে হয়। এভাবে আবু এ জুতার জন্যই অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অবশেষে কাজির কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বললে কাজি সাহেব তাকে জরিমানা থেকে মুক্তি দেন।

শব্দার্থ - বাগদাদ ইরাকের রাজধানী; শিক্ষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর। দিনার – ইরাকের মুদ্রার নাম। জিন্দেগি = সারা জীবন । কাবার - শেষ। কান দেওষ্মা = শােনা। পরমায় = দীর্ঘ জীবন। খােশ খবর = সুসংবাদ। সওদাগর - ব্যবসায়ী। নলিব -- মন্দ ভাগ্য। বসা – ইরাকের একটি বাণিজ্যিক শহর। কারবার – ব্যবসা। খুশিতে আটখানী – খুবই আনন্দিত। হাম্মাম - গােসলখানা; স্নানাগার। পেনশন দিয়ে -- বাদ দিয়ে বা প্রত্যাখ্যান করা অর্থে। সাড়া পড়ে গেল – আলােড়ন সৃষ্টি হলাে অর্থে। কমবখত - হতভাগ্য, দুর্ভাগা; বুদ্ধিহীন। দর – বিচারালয়। সে যাত্রা – সে সময়; সে-বার। নাগরাই -- চামড়ার একপ্রকার জুতাে! স্থারেক রকম = বিভিন্ন রকম! কেলিঙ্ক = কষ্ট; দুর্ভোগ। অপয়া = অমঙ্গলজনক অশুভ অলক্ষণা কুলক্ষণা । সন্ধি -- সবকিছু। মতল - ফন্দি। দীও মারা - সহজে মােটা লাভ করা। খেসারত -- ক্ষতিপূরণ । ফরিয়াদ = প্রার্থনা। মামলা-মােকক্ষময় - আদালতে অভিযোেগ। ইনসাঙ্ক = বিচার; ন্যায়বিচার। 

সৃজনশীল প্রশ্ন রাজার হয়েছে ভীষণ অসুখ। কবিরাজ-বদ্যির ঔষুধে কোনাে কাজ হচ্ছে না। অবশেষে একজন দিল মােক্ষম দাওয়াই। সুখী মানুষ খুঁজে বের করে তার জামা এনে পরাতে হবে রাজাকে। রাজ্যজুড়ে খোজ করে সুখী মানুষ একজন পাওয়া গেল বটে কিন্তু তার কোনাে জামা ছিল না। তাই রাজার বালাই দূর হলাে না। ক, আলী আবু জেলখাটা থেকে রেহাই পেতে মােট কত দিনার জরিমানা দিয়েছিল? খ. কিন্তু আবুর পায়ে সেগুলােকে আর দেখা যায়নি’- কেন? গ. রাজা ও আলী আৰুর সমস্যার মধ্যে সাদৃশ্য নির্দেশ কর। ঘ. ‘সুখী মানুষের জামা কাল্পনিক দাওয়াই হলেও আলী আবুর জুতাে বাস্তবিক বালাই- মন্তব্যটির যথার্থতা 
বিশ্লেষণ কর।

Post a Comment

0 Comments