এই সেই জেদ্দা যার কথা শৈশব হতে শুনে আসছি। নামের পরশে চিত্ততলে জেগে উঠেছে কত দূরদূরাত্রে স্বপন। কত রােমাঞ্চকর কল্পকাহিনী। কত ব্যথা-বিদগ্ধ স্মৃতি। দেশ-দেশান্তরের কত হজযাত্রী এই জেদ্দায় জাহাজ হতে নামে, এসেছি রসুলুল্লাহ, তােমার দেশে এসেছি, এসেছি, আল্লাহ, তােমার প্রথম এবাদত-গাহের মুলুকেএসেছি বলে কত আকুল প্রাণ কেঁদে উঠে। উত্তেজনার আতিশয্যে কত বয়ােদুর্বল যাত্রী এখানেই ঢলে পড়ে, তাঁদের মক্কা-মদিনা জিয়ারত আর হয়ে উঠে না; তারা প্রতীক্ষমাণ আপন জনের এ-দুনিয়ার ঘরেও আর ফিরে যায় না। সমগ্র আরবের ছবি মনের চোখে ভেসে উঠল। সেমিটিক জাতিসমূহের লালন-ভূমি এই আরব। এই আরবদেরই এক শাখা ব্যাবিলনে গিয়ে উপনিবেশ
স্থাপন করে। ফিলিনি, আবিসিনিয়া এদের দিয়েই আবাদ হয়। বিভিন্ন রকম শিলালিপি হতে এখন। প্রমাণিত হয়েছে যে, হযরত ঈসার কম-সে-কম হাজার বছর আগে আরবে এক বিরাট সভ্যতা বর্তমান ছিল। ? তারপর আসে পতনের যুগ।
খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে আরবের বুকে বিরাজ করতে থাকে অজ্ঞতার ভয়াবহ অন্ধকার, বল্গাহীন অনাচার আর জুলুম। মুক্তির বাণী নিয়ে আসেন মরুসূর্য মুহাম্মদ (স.); নতুন আলােকের পরশে আরবের বালুকারাশি পর্যন্ত জ্বলে ভাস্বর হয়ে উঠে। দিকে দিকে গড়ে উঠে নতুন নতুন জাতি, নতুন নতুন রাজ্য, নতুন নতুন সভ্যতা। তারপর মুসলমানের জাতীয় জীবনে শুরু হয় অবনতির ভাটা, ইসলামের সত্য সনাতন আদর্শ ভুলে তারা চলে ভুল পথে, ডেকে আনে নিজেদের মৃত্যু। আজরাইল শিয়রে এসে বসে জান কবজ করতে তৈরি হয়। এমন সময় আবির্ভাব ঘটে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহহাবের। মধ্য আরবের অন্তর্গত আযাইনাতে জন্ম। বসরা, দামেস্ক ও মক্কায় অধ্যয়ন শেষ করে এই সংস্কারক ১৮৫০ সালে জন্মভূমিতে ফিরে আসেন ও ঘােষণা করেন মুসলমানেরা ইসলামের পথ হতে অনেক অনেক দূর সরে গিয়েছে তাদের আজকের এই দুর্বলতা, এই বেইজ্জতি এরই জন্য। অতএব মুসলমানকে আগের পথে ফিরে যেতে হবে, ধর্মে ফিরে যাওয়ার মধ্যেই তার পুনর্জীবন লাভের একমাত্র পথ। যা ইসলামের বিরােধী তার সাথে কোনাে আপস নেই, কারণ সে আপসের পরিণাম জাতির অধঃপতন। আযাইনার আমির আব্দুল ওহ্হাবকে আপদ মনে করে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন। তিনি আশ্রয় পেলেন দারিয়া র আমির উদারহৃদয় ইবনে সউদের কাছে। মুহাম্মদ ইবৃনে আব্দুল ওহাবের আহবানে দলে দলে বেদুঈন এসে তাঁর এই সংস্কারপন্থী মত গ্রহণ করতে লাগল এবং নতুন নতুন সংস্কারের জন্য পাগল হয়ে উঠল।
আর এদিকে মুহম্মদ ইবৃনে সউদ তাঁদের সমর-শিক্ষায় নিপুণ করে তুলতে লাগলেন। এই নবগঠিত সৈন্যদলের সাহায্যে মুহম্মদ ইবনে সউদ কিছুদিনের মধ্যে সমগ্র মধ্য ও পূর্ব আরবে তার শক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। এমনিভাবে আরবে সউদি শক্তি শিকড় গেড়ে বসল। মুহম্মদ ইবৃনে সউদের মৃত্যুর পর তার পুত্র আব্দুল আজিজ পিতার রাজ্যের সীমাকে আরও প্রসারিত করেন। আরব তখন তুর্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। এবার তুর্ক প্রভুদের টনক নড়ল। তাঁরা তাঁকে দমন করতে লােক লস্কর পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু তুর্ক সৈন্যরা কিছু করতে পারল না; ফিরে গেল। শােনা যায়, আবদুল আজিজ তুর্ক আক্রমণের জওয়াবে কারবালা ও মক্কা দখল করে সেখানকার মাজারগুলােকে একে একে ধূলিসাৎ করে ফেলেন ও বহু পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন লুট করে নিজের রাজধানীতে নিয়ে যান। আব্দুল আজিজের এই ব্যবহারে ব্যথিত হয়ে একজন শিয়া একদা দারিয়ার মসজিদে হঠাৎ আক্রমণ করে আবদুল আজিজকে হত্যা করেন। এমনিভাবে কখনাে জোয়ার কখনাে ভাটার ভিতর দিয়ে সউদি শক্তি কালের তীর বেয়ে চলতে থাকে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। তখন শাহজাদা আবদুল আজিজ পিতা আব্দুর রহমানের সাথে কুয়েতে নির্বাসিত, ক্ষমতা তখন মুহম্মদ ইবনে রশিদ নামক এক বিচক্ষণ আমিরের কুক্ষিগত। মাত্র কয়েকজন অনুচরসহ একদা শাহজাদা আব্দুল আজিজ পিতার তাঁবু হতে বের হয়ে ধূসর মরুর দু পথে বিলীন হয়ে গেলেন। তারপর এদিক-সেদিক ওঁত পেতে থেকে এক রাতের অন্ধকারে রাজধানী রিয়াদের উপর ঝাপিয়ে পড়লেন, শাসনকর্তাকে পরাজিত করে হত্যা করলেন, তারপর নিজকে রিয়াদের আমির বলে ঘােষণা করে চারদিকে তাঁর শক্তিবৃদ্ধির কাজে মনে-প্রাণে লেগে গেলেন। ইনিই সৌদি আরবের অধিপতি মহামান্য রাজা আবদুল আজিজ ইবনে সউদ। আজ এ আমির, কাল ও আমিরের সঙ্গে মিলে আবদুল আজিজ আপনার শক্তি বাড়িয়ে তুলতে লাগলেন। ইতােমধ্যে প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। আবদুল আজিজ ব্রিটিশ পক্ষ গ্রহণ করে নিজের শক্তিবৃদ্ধির নতুন নতুন পথ খুঁজতে লাগলেন। এদিকে মক্কার শরীফ হােসেন ইবনে আলী তুর্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে ওঁ নিজেকে আরব দেশগুলাের রাজা বলে ঘােষণা করে বসলেন। আবদুল আজিজ চাপা তুঙ্কারে কেবল বললেন
বটে! আচ্ছা !! অবশেষে ১৯১৭ সালে আব্দুল আজিজ ও শরীফ হােসেনের মধ্যে রণভেরী বেজে উঠল। আব্দুল আজিজের প্রচণ্ড আক্রমণের সামনে শরীফের সৈন্য টিকতে পারল না।
১৯২৫ সালে আব্দুল আজিজ তায়েফ, মক্কা ও মদিনা দখল করে নিলেন। এমনিভাবে তিনি নেজুদ ও হেজাজের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসলেন। হজ উপলক্ষে যে আয় হয় এতকাল পর্যন্ত তাই ছিল সৌদি আরবের প্রধান সম্পদ। সে আয় আজো আছে; কিন্তু ইদানীং তেলই সৌদি আরবের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারস্য উপসাগরের তীরে বাহুরান নামক স্থানে এই তেলের খনি—এক মার্কিন কোম্পানি এই তেলের ব্যবসা করছে; সৌদি আরব অচিরেই ধনী দেশের মধ্যে গণ্য হবে। মক্কা-মদিনার মধ্যস্থ একস্থানে একটি সােনার খনিও আবিষ্কৃত হয়েছে।
আমরা যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই সুলতান আব্দুল আজিজের প্রভাবের পরিচয় প্রত্যক্ষ করেছি। শরীফীয় আমলে ডাকাতের জুলুমের অন্ত ছিল না। কাফেলা ছেড়ে কোনাে যাত্রী একটু পেছনে পড়লে সে ফিবে, না কোনাে ডাকাতের পাথরের আঘাতে পথেই পড়ে থাকবে, তার নিশ্চয়তা ছিল না। কোনাে সময়। কাফেলাই আক্রমণ করে বসত। এখন সেসব কিছুই নেই। চুরিও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। জেদ্দা হতে মদিনা সে যুগে উটের পিঠে ১২ দিনে যেতে হতাে। এখন মােটর বাসে দুই দিনে যাওয়া যায়; হাওয়াই জাহাজে যেতে লাগে দেড় ঘণ্টা। পানির ব্যবস্থা আগের চেয়ে ভালাে হয়েছে। আগের দিনে মাছির জ্বালায় ঠিক হয়ে বসার জো ছিল না; সেই ডরে আমরা মশারি নিয়েছিলাম। কিন্তু বাক্স হতে মশারি বের করতে হয় নি। মক্কা ও জেদ্দায় ভালাে ভালাে রাস্তা ও দালান-কোঠা তৈরি হচ্ছে- শুনলাম মার্কিন পরিকল্পনা মােতাবেক। মক্কার বাজারে রেশম পশমের পােশাক-পরিচ্ছদও যে পরিমাণ দেখলাম, ঢাকার বাজারে তা নেই। সৌদি আরবের দিন দিন উন্নতি হােক। আমরা এই কামনা করি।
লেখক-পরিচিতি ইবরাহীম খাঁ ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে টাংগাইল জেলার শাবাজনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. ও বি.এল. পাস করে প্রথমে ময়মনসিংহ শহরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। পরে শিক্ষকতায় যােগদান করে দীর্ঘদিন করটিয়া সা’দত কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ছােটগল্প, নাটক, রম্য রচনা ও উপন্যাস লিখে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
সারসংক্ষেপ লেখক রসুলের দেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে জেদ্দায় অবতরণ করেন। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল আরবের ছবি। সেমিটিক জাতিসমূহের লালনভূমি আরব দেশ। এ আরব দেশের একটি শাখা ব্যাবিলনে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করে। খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে আরব ছিল অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এ সময় আরবের মানুষকে অন্ধকার থেকে আলাের দিকে নিয়ে যেতে আসেন শেষ নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)। দিকে দিকে গড়ে উঠে নতুন সভ্যতা। এক পর্যায়ে আবার শুরু হয় মুসলমানদের অবনতি। এমন সময় আবির্ভাব হয় মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহহাবের। ইসলামের জাগরণের কাজ শুরু হয়। তাকে আপদ মনে করে আইনার আমির রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন। দারিয়া-র আমিরের আশ্রয় লাভ করে তিনি পুনরায় মুসলমানদের জন্য কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আরবের অধিপতি আবদুল আজিজ একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসেন।
শব্দার্থ জেদ্দা – সৌদি আরবের একটি শহর ও সামুদ্রিক বন্দর। চিত্ততলে-মনের মাঝে। কল্পকাহিনী আজগুবি কাহিনী বা গল্প। এবাদত-প্রার্থনা, মােনাজাত। শিলালিপি-পাথরে খােদিত লেখা। মরুসূর্য-মরুভূমিতে যে সূর্য উঠে। এখানে ইসলামের শেষ নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) কে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করে মরুসূর্য বলা হয়েছে। অন্ধকার – আঁধার। শতাব্দী – শতবর্ষ কাল। সংস্কারক – যে সংস্কার করে, উৎকর্ষ সাধক। সনাতন অনাদিকাল হতে প্রচলিত, যা পূর্বে ছিল। আবির্ভাব – উপস্থিত হওয়া। বিচক্ষণ – বুদ্ধিমান। রণভেরী যুদ্ধের বাজনা। কাফেলা – যাত্রীদল। অধিপতি –রাজা, প্রভু। মক্কা— সৌদি আরবের একটি শহর। এখানে হযরত মুহাম্মদ (স.) জন্মগ্রহণ করেন এবং এখানেই কাবা শরীফ অবস্থিত। মদিনা – আরবের একটি শহর, মুসলমানদের তীর্থস্থান। আজরাইল – একজন ফেরেশতা, তিনি মানুষের জান কবজ করেন।
সৃজনশীল প্রশ্ন
বাংলার মুসলমান যখন অজ্ঞতা আর কুসংস্কারে হাবু-ডুবু খাচ্ছিল তখন আবির্ভাব ঘটে হাজী শরীয়ত উল্লাহর। তিনি জীবন থেকে সকল কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে ধর্মের প্রকৃত আলােয় আলােকিত হবার আহ্বান জানান। তিনি মানুষের প্রকৃত অধিকার সম্পর্কেও সচেতন করার চেষ্টা করেন। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি ও এদেশীয় জমিদারদের শােষণমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও তিনি এ দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করায় ভূমিকা রাখেন।
ক. কোন শতাব্দীতে আরবের বুকে “অজ্ঞতার ভয়বহ অন্ধকার” বিরাজ করছিল ?
খ. আযাইনার আমির কেন আব্দুল ওহহাবকে আপদ মনে করলেন?
গ. উদ্দীপকের হাজী শরীয়ত উল্লাহর ‘সংস্কারমূলক কাজের সঙ্গে ‘রসুলের দেশে ভ্রমণ কাহিনীর কার কাজের তুলনা করা যায়? বর্ণনা কর।
ঘ. উদ্দীপকের হাজী শরীয়ত উল্লাহর ‘চেতনার সাথে ‘রসুলের দেশে’ গল্পের আব্দুল
আজিজের কর্মকাণ্ডের সঙ্গতিপূর্ণ দিকটি বিশ্লেষণ কর।
0 Comments