লন্ডন পৌছার দুদিন পরেই আমরা করা ঈদের নামায পড়তে গেলাম লন্ডন থেকে মাইল তিরিশেক দূরে ওকিং মসজিদে। লন্ডনে মুসলমানদের আরও কয়েকটি মসজিদ আছে। কিন্তু ওকিং সবচেয়ে বিখ্যাত মসজিদ। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা হবে। মসজিদ কমিটির সৌজন্যে অন্তত একটি বেলার জন্য সিদ্ধ খাবারের দেশে রসনা পরিতৃপ্তিকর মুসলমানি খানা খাওয়া যাবে। আরও দেখা যাবে দুনিয়ার নানা জাতির মুসলমানকে-এক ঢিলে এতগুলাে পাখি মারা যাবে দেখে লন্ডন প্রবাসীরা তাে বটেই, এমনকি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থানকারী মুসলমানরাও ঈদের দিনটিতে ওকিং-এ নামাজ পড়তে আসে।
মুসলমানদের ঈদের নামাযের ধর্মানুভূতি ও ধর্মানুষ্ঠান ছাড়াও একটা বড় দিক আছে। সেটা হলাে তার সামাজিক দিক। এর মাধুর্য ও সৌন্দর্য কম নয়। এক আল্লাহ ও রসুলকে কেন্দ্র করে এক ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে কী করে একত্র করেছে; ছােট্ট এ ওকিং মসজিদের প্রাঙ্গণে তার অপরূপ রূপ দেখে সত্যিই মন চমকৃত হয়। ঈদের দিনে ওকিং-এ এসে নানা জাতের সলমানদের মিলনে জামায়াত ও ওঁ মিল্লাতের এ দিকটা এত করে চোখে পড়ে যে, অমুসলিমও তাতে আকৃষ্ট না হয়ে পারে না।
এখানে এসে আর একটা নতুন জিনিস চোখে পড়ল। ইসলাম ধর্ম যে জগতের নানা দেশে ছড়িয়ে আছে তার চাক্ষুষ পরিচয় পেলাম। মিসর, আরব, সিরিয়া, ইরাক, পারস্য, মালয়, ইন্দোনেশিয়া, চীন এবং আফ্রিকার বহু মুসলমান এসেছে। আর ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আমরা তাে অনেকেই ছিলাম। এক-এক দেশের লােক দেখতে এক-এক রকম। ভিন্ন ভিন্ন রকমের চেহারা ও শরীর অথচ ঈদের নামায পড়তে এসে সব দেশের মুসলমানই ধর্ম বাঁধনে ভাই ভাই হয়ে গেছে।
নামায শেষে চেনা-অচেনা নানা দেশের মুসলমানের কোলাকুলি দেখে কী যে আনন্দ পাওয়া গেল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এ কোলাকুলি একদিকে যেমন মুসলমানে মুসলমানে, অন্যদিকে তেমনি জাতিতে জাতিতে। নামায হলাে আরবিতে। কিন্তু ইমাম সাহেব খােতবা পড়লেন সকলের বােধগম্য ভাষা ইংরেজিতে। যাদের কাছে খােতবা পড়া হয়, তাদের ইসলামের সারকথা বােঝানােই খােতর অর্থ। ওখানে নানা দেশের নানা লােক এসেছিল। এরা মােটামুটি সকলেই ইংরেজি বােঝে। খােতবায় ইমাম সাহেব বুঝাচ্ছিলেন। সকলের শােনার ধরন দেখে মনে হলাে সকলেই তা বুঝছে। ইংল্যান্ডের মতাে আমাদের দেশের এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার প্রয়ােজন আছে। আমাদের দেশে যদি মাতৃভাষায় খােটা পড়া হতাে তাহলে অনেক মঙ্গল হতাে আমাদের সাধারণ মুসলমানদের।
নানা দেশের অমুসলমানরাও ওকিং-এ এসেছে নানা বেশভূষায়। কেউ দেখতে, আর কেউ বন্ধুদের নেম খেতে। ইংরেজরা সিদ্ধ ছাড়া তাে কিছু খেতে জানে না। এ সুযােগে তাই এখানকার প্রবাসী মুসলমানেরা তাদের বন্ধু-বান্ধবদের মুসলমানি খাবার খাইয়ে বন্ধুত্ব গাঢ় করে।
নামাযের পরে নামাযের তাঁবুতেই মসজিদ কমিটির তরফ থেকে কয়েকবারে হাজার দেড়েক লােক খাওয়ানাে হলাে। সবাই তৃপ্তির সঙ্গে খেলাম পােলাও আর কালিয়া। ওকিং-এর এ খাওয়ার মধ্যে আর একটু বৈশিষ্ট্য আছে। মুসলমানদের হাতে জবাই করা টাটকা গােশত ঈদের নামাজ উপলক্ষে একটি দিনের জন্য এখানেই পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডের গােশতের মােটা ভাগ আসে আর্জেন্টিনা থেকে। বিদেশ থেকে যে গােশত ইংল্যান্ডে আসে জবাই হবার পর থেকে মানুষের পেটে গিয়ে পৌছুতে তার তিন-চারটে মাস সময় লেগে যায়।
ঠাণ্ডা দেশ বলে গােশত নষ্ট হয় না। এর উপরে আছে রেফ্রিজারেটার আর বরফ। দোকানে দিনের পর দিন এ গােশত ঝুলতে দেখা যায়। সুতরাং ঈদের দিন সাধারণ মুসলমান টাটকা গােশত খাবার আনন্দ মেটায়। আর ধর্মভীরুরা বহুদিন রােজা থাকার পর হালাল গােশত খাবার সুযােগ পেয়ে আল্লাহর কাছে এখানে শােকর গােজার করে।
পৃথিবীর জনসমুদ্রের সঙ্গে মিশবার ও বিচিত্র শােভা দেখবার সুযােগ পাই লন্ডনে। আজকের দিনে আরও শােভা দেখলাম মুসলমান জগতের। লন্ডন দুনিয়ার কসমােপলিটান শহরগুলাের অন্যতম। ইংরেজ রাজত্বের সমৃদ্ধির সঙ্গে লন্ডন শহর দুনিয়ার নানা দেশেরই স্নায়ুকেন্দ্র এবং তীর্থক্ষেত্র হয়ে রয়েছে। এখানে নানা দেশ থেকে নানা লােক আসে। নানা কিছু শিখতে ও দেখতে। তাই ইংল্যান্ড ভরে আছে নানান দেশের মুসলমানেও।
ইসলাম বিশেষ কোনাে একটি জাতির ধর্ম নয়। নানা জাতি, নানা দেশ এ ধর্মের বাঁধনে কী অদ্ভুতভাবে বাঁধা পড়েছে। এখানকার ঈদের দিনে ওকিং তার অপূর্ব দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। ওকিং মসজিদের সামনে বিরাট শামিয়ানা খাটানাে হয়। তার চারধার দিয়ে এক-একটা মুসলিম দেশের পতাকা টাঙানাে হয়। পতাকাগুলাের দিকে একবার চোখ বুলালেই সে দেশের জাতীয় সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়।
ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সউদি আরব, ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, জর্দান, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, মরক্কো প্রভৃতি দেশের এক-এক নিশান আকাশে উড়ছে। আর মাটিতে এক-এক দেশের অপূর্ব পােশাক-পরিচ্ছদ ভূষিত এক-এক রকম চেহারার নর-নারী। তার মধ্যে আফ্রিকার নিগ্রো মুসলমানের পােশাক পরিচ্ছদই অদ্ভুত ধরনের। ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানেরা, চীন ও জাপানের পীত জাতের মধ্যে যেমন রঙের সুষমা রক্ষা করেছে, তেমনি মরক্কোর মুসলমানেরা ইউরােপের শ্বেত জাতির সবচেয়ে নিকটবর্তী বলে রঙের দিক থেকে ভারসাম্য রক্ষা করেছে। মাঝখানে আমরা বাঙালিরা না কালাে না ফরসা। কিন্তু আফ্রিকার নিগ্রোরা জমকালাে। ওকিং-এ দেখলাম নানান জাতির ক্লাস, পােশাক আর নানা জাতির নানা রং। এত বৈষম্য অপূর্ব সুন্দর বাঁধনে বাঁধা পড়েছে। সে বাঁধন হচ্ছে এক আল্লাহ এবং তাঁর রসুলে বিশ্বাস।
লেখক-পরিচিতি মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার মরিচা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত এ ধ্বনিবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘদিন উক্ত বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা জুন এক ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। লন্ডনে অধ্যয়নকালে সেখানকার জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতার আলােকে লেখা তাঁর বিখ্যাত
ভ্রমণকাহিনী ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন। তাছাড়া তাঁর অন্যান্য উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হলাে; ধ্বনিবিজ্ঞান ও ৪ ধ্বনিতত্ত্ব, রাজনীতি ও তােষামােদের ভাষা।
সারসংক্ষেপ মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯৫২ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। সে সময় তাঁকে সাড়ে সাতশ দিন বিলেতে কাটাতে হয়েছিল। প্রবাসজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ গ্রন্থে। উক্ত গ্রন্থের সামান্য একটু অংশ হচ্ছে ‘ওকিং মসজিদে ঈদের জামায়াত। লন্ডনের মতাে কসমােপলিটান শহরেও কী সুন্দর ও আনন্দদায়ক ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়, তারই একটি সুন্দর বর্ণনা এখানে আছে। দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও অপূর্ব এক সুন্দর বাঁধনে বাঁধা পড়ে আছে বিশ্বের সকল মুসলমান; আর সেটা হচেছ ধর্মানুভূতির বাঁধন।
শব্দার্থ ও টীকা ধর্মানুভূতি – ধর্মের জন্য অনুভূতি। প্রাঙ্গণ – অঙ্গান, উঠান। চমকৃত – বিস্মিত। সৌজন্য – ভদ্রতা। চাক্ষুষ - নিজের চোখে দেখা, প্রত্যক্ষ। হালাল - মুসলমান ধর্মমতে বৈধ বা পবিত্র। খােতবা (খােত্ব) ইসলামের বিজয় ঘােষণা। কসমােপলিটান বহুজাতিক, বহু জাতের সমাবেশ। দৃষ্টান্ত – উদাহরণ।
সৃজনশীল প্রশ্ন আমরা সবাই রংধনু দেখেছি। সাতটি স্বতন্ত্র রঙের কী সুন্দর বিন্যাস! বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল- ভিন্ন হয়েও অভিন্ন। একই আকাশে একই উৎস থেকে উৎপন্ন হয়ে সাম্যের বন্ধনে কী সুন্দর অবস্থান!
ক, কসমােপলিটান' শব্দটির অর্থ কী?
খ. মুহম্মদ আবদুল হাই মাতৃভাষায় খােতবা পড়ার জন্য কেন গুরুত্ব দিয়েছেন?
ওকিং মসজিদে ঈদের জামায়াত
গ. উদ্দীপকের রং-বৈচিত্র্য ‘ওকিং মসজিদে ঈদের জামায়াত’ ভ্রমণকাহিনীর যে দিকটির
প্রতিফলন ঘটেছে তা ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “রংধনুর রঙের সাম্যের বন্ধনের মতাে জীবনও সুন্দর বাঁধনে বাঁধা পড়েছে।” ‘ওকিং মসজিদে ঈদের জামায়াত’ ভ্রমণকাহিনীর আলােকে বিশ্লেষণ কর।
0 Comments