তােতাকাহিনী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


1
এক-যে ছিল পাখি। সে ছিল মূখ। সে গান গাহিত, শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত, উড়িত, জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে। 
রাজা বলিলেন, ‘এমন পাখি তাে কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লােকসান ঘটায়।
মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘পাখিটাকে শিক্ষা দাও। 

2

রাজার ভাগিনাদের উপর পড়িল পাখিকে শিক্ষা দিবার দায়িত্ব।

পণ্ডিতেরা বসিয়া অনেক বিচার করিলেন। প্রশ্নটা এই, উক্ত জীবের অবিদ্যার কারণ কী। 
সিদ্ধান্ত হইল, সামান্য খড়কুটা দিয়া পাখি যে-বাসা বাঁধে সে-বাসায় বিদ্যা বেশি ধরে না। তাই সকলের আগে দরকার, ভালাে করিয়া খাচা বানাইয়া দেওয়া। 

রাজপণ্ডিতেরা দক্ষিণা পাইয়া খুশি হইয়া বাসায় ফিরিলেন। 

3

স্যাকরা বসিল সােনার খাঁচা বানাইতে। খাঁচাটা হইল এমন আশ্চর্য যে, দেখিবার জন্য দেশ-বিদেশের লােক ঝুঁকিয়া পড়িল। কেহ বলে, “শিক্ষার একেবারে হদ্দমুদ্দ। কেহ বলে, “শিক্ষা যদি নাও হয়, খাঁচা তাে হইল। পাখির কী কপাল। 

স্যাকরা থলি বােঝাই করিয়া বকশিশ পাইল। খুশি হইয়া সে তখনি পাড়ি দিল বাড়ির দিকে।। 

পণ্ডিত বসিলেন পাখিকে বিদ্যা শিখাইতে। নস্য লইয়া বলিলেন, “অল্প পুঁথির কর্ম নয়।' 

ভাগিনা তখন পুঁথিলিখকদের তলব করিলেন। তারা পুঁথির নকল করিয়া এবং নকলের নকল করিয়া পর্বত প্রমাণ করিয়া তুলিল। যে দেখিল, সেই বলিল, ‘সাবাস। বিদ্যা আর ধরে না। 

লিপিকরের দল পারিতােষিক লইয়া বলদ বােঝাই করিয়া তখনি ঘরের দিকে দৌড় দিল। তাদের সংসারে আর টানাটানি রহিল না। 

অনেক দামের খাঁচাটার জন্য ভাগিনাদের খবরদারির সীমা নাই। মেরামত তত লাগিয়াই আছে। তার পরে ঝাড়া মােছা-পালিশ করার ঘটা দেখিয়া সকলেই বলিল, “উন্নতি হইতেছে।' 

লােক লাগিল বিস্তর এবং তাদের উপর নজর রাখিবার জন্য লােক লাগিল আরও বিস্তর। তারা মাস-মাস মুঠা মুঠা তনখা পাইয়া সিন্দুক বােঝাই করিল। 

তারা এবং তাদের মামাতাে, খুড়তুতাে, মাসতুতাে ভাইরা খুশি হইয়া কোঠা-বালাখানায় গদি পাতিয়া বসিল। 
4

সংসারে অন্য অভাব অনেক আছে, কেবল নিন্দুক আছে যথেষ্ট। তারা বলিল, ‘খাঁচাটার উন্নতি হইতেছে, কিন্তু পাখিটার খবর কেহ রাখে না। 

কথাটা রাজার কানে গেল। তিনি ভাগিনাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ভাগিনা, এ কী কথা শুনি। 

ভাগিনা বলিল, “মহারাজ, সত্য কথা যদি শুনিবেন তবে ডাকুন স্যাকরাদের, পণ্ডিতদের, লিপিকরদের, ডাকুন যারা মেরামত করে এবং মেরামত তদারক করিয়া বেড়ায়। নিন্দুকগুলি খাইতে পায় না বলিয়াই মন্দ কথা বলে। 

জবাব শুনিয়া রাজা অবস্থাটা পরিষ্কার বুঝিলেন, আর তখনই ভাগিনাদের গলায় সােনার হার চড়িল। 

5

শিক্ষা যে কী ভয়ঙ্কর তেজে চলিতেছে, রাজার ইচ্ছা হইল স্বয়ং দেখিবেন। একদিন তাই পাত্র-মিত্র-অমাত্য লইয়া শিক্ষাশালায় তিনি স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত।

দেউড়ির কাছে অমনি বাজিল শাখ ঘণ্টা ঢাক ঢােল কাড়া-নাকাড়া তুরী ভেরী দামামা কঁসি বাঁশি কাঁসের খােল করতাল মৃদঙ্গ জগঝম। পণ্ডিতেরা গলা ছাড়িয়া, টিকি নাড়িয়া, মন্ত্রপাঠে লাগিলেন। মিস্ত্রি মজুর স্যাকরা। লিপিকর তদারকনবিশ আর মামাতাে, পিসতুতাে এবং মাসতুতাে ভাই জয়ধ্বনি তুলিল।

ভাগিনা বলিল, “মহারাজ কাণ্ডটা দেখিতেছেন?
মহারাজ বলিলেন, “আশ্চর্য। শব্দ কম নয়।

ভাগিনা বলিল, শুধু শব্দ নয়, পিছনে অর্থও কম নাই।

রাজা খুশি হইয়া দেউড়ি পার হইয়া যেই হাতিতে উঠিবেন এমন সময়, নিন্দুক ছিল ঝােপের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়া, সে বলিয়া উঠিল, “মহারাজ, পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি?

রাজার চমক লাগিল; বলিলেন, ‘ঐ যা। মনে তাে ছিল না। পাখিটাকে দেখা হয় নাই।।

ফিরিয়া আসিয়া পণ্ডিতকে বলিলেন, ‘পাখিকে তােমরা কেমন শেখাও তার কায়দাটা দেখা চাই।”

দেখা হইল। দেখিয়া বড় খুশি। কায়দাটা পাখিটার চেয়ে এত বেশি বড় যে, পাখিটাকে দেখাই যায় না; মনে হয়, তাকে না দেখিলেও চলে। রাজা বুঝিলেন, আয়ােজনের ত্রুটি নাই। খাচায় দানা নাই, পানি নাই; কেবল রাশি রাশি পুঁথি হইতে রাশি রাশি পাতা ছিড়িয়া কলমের ডগা দিয়া পাখির মুখের মধ্যে ঠাসা হইতেছে। গান তাে বন্ধই, চিৎকার করিবার কটুকু পর্যন্ত বােজা। দেখিলে শরীরের রােমাঞ্চ হয়।

এবারে রাজা হাতিতেই চড়িবার সময় কানমলা-সর্দারকে বলিয়া দিলেন, নিন্দুকের যেন আচ্ছা করিয়া কানমলা দেওয়া হয়।

6

পাখিটা দিনে দিনে ভদ্র-দস্তুরমতাে আধমরা হইয়া আসিল। অভিভাবকেরা বুঝিল, বেশ আশাজনক। তবু স্বভাবদোষে সকালবেলার আলাের দিকে পাখি চায় আর অন্যায় রকমে পাখা ঝটপট করে। এমন-কি, এক একদিনে দেখা যায় সে তার রােগা ঠোঁট দিয়া খাচার শলা কাটিবার চেষ্টায় আছে।

কোতােয়াল বলিল, “এ কী বেয়াদবি।” তখন শিক্ষামহলে হাপর হাতুড়ি আগুন লইয়া কামার আসিয়া হাজির। কী দমাদ্দম পিটানি। লােহার শিকল তৈরি হইল, পাখির ডানাও গেল কাটা।


রাজার সম্ফদ্ধীরা মখ হাঁড়ি করয়িা মাথা নাড়িয়া বলিল, “এ রাজ্যে পাখিদের কেবল যে আক্কেল নাই তা নয়, রাজার সম্বন্ধীরা কৃতজ্ঞতাও নাই। 

তখন পণ্ডিতেরা এক হাতে কলম, এক হাতে সড়কি লইয়া এমনি কাণ্ড করিল যাকে বলে শিক্ষা।

কামারের পসার বাড়িয়া কামারগিন্নির গায়ে সােনাদানা চড়িল এবং কোতােয়ালের হুঁশিয়ারি দেখিয়া রাজা তাকে শিরােপা দিলেন।

পাখিটা মরিল। কোনকালে যে কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই। নিন্দুক লক্ষ্মীছাড়া রটাইল, ‘পাখি মরিয়াছে।

ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন, ‘ভাগিনা, এ কি কথা শুনি।

ভাগিনা বলিল, “মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।

রাজা শুধাইলেন, ‘ও কী আর লাফায়?

ভাগিনা বলিল, “আরে রাম!”

“আর কি ওড়ে?

না।

‘আর কি গান গায়?

না।

‘দানা না পাইলে আর কি চেঁচায়?

না। 

রাজা বলিলেন, “একবার পাখিটাকে আনাে তাে, দেখি।
পাখি আসিল। সঙ্গে কোতােয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘােড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হঁ করিল না, হুঁ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনাে পাতা খসখস্ গজগজ করিতে লাগিল।

বাহিরে নববসন্তের দক্ষিণ হাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিঃশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল করিয়া দিল।

লেখক-পরিচিতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে (৭ই মে ১৮৬১ সাল) কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষালাভ তিনি করেননি, কিন্তু সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেত্রে তার পদচারণ এক বিস্ময়কর। ব্যাপার। তিনি ছিলেন অসামান্য প্রতিভাধর। বাল্যকালেই তাঁর প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তার  বনফুল’ কাব্য প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি' কাব্যের জন্য সাহিত্যে নােবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্য প্রযােজক, অভিনেতা ছিলেন। কাব্য, ছােটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান ইত্যাদি সাহিত্যের সব শাখায় তিনি সমানভাবে পদচারণ করেছেন। তাঁর অনেক রচনার মধ্যে মানসী’, ‘সােনার তরী’, ‘চিত্রা, ক্ষণিকা’, ‘চোখের বালি’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘গােরা’, ‘যােগাযােগ’, ‘শেষের কবিতা', 'রক্ত করবী’, ‘গল্পগুচ্ছ' বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ (৭ই আগস্ট, ১৯৪১) এই মহান কবি কলকাতায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 

সার-সংক্ষেপ একটি পাখিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য রাজা মন্ত্রীকে আদেশ দিলেন। রাজার নিকটাত্মীয়রা এ দায়িত্ব পেল। পণ্ডিতেরা অনেক বিচার-বিবেচনা করে বললেন,পাখিদের বাসা ছােট এবং খড়কুটার তৈরি, তাই এতে বিদ্যা ধরে না। তাই খাঁচা বানানাের পরামর্শ দিয়ে দক্ষিণা নিয়ে চলে গেলেন। স্যাকরা সােনার খাঁচা তৈরি করে দিয়ে থলি বােঝাই বখশিশ নিয়ে গেল। পণ্ডিতেরা পাখিটাকে বিদ্যাশিক্ষা দেওয়ার জন্য লেগে গেলেন। তারা আরও পুঁথি লিখিয়ে নিলেন। লিপিকররা পারিতােষিক নিয়ে চলে গেলেন। খাঁচা তৈরি ও অন্যান্য কাজে অনেক লােক লাগল। পাখিকে বিদ্যাশিক্ষা দেওয়ার জন্য বিশাল আয়ােজন চলতে লাগল। রাজা মাঝে মাঝে খোঁজ নিলেও নিজের আত্মীয়-স্বজনরা তাকে ভুল বুঝিয়ে আসল সত্য লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সমাজে একশ্রেণির মানুষ আছে, যারা সত্য প্রকাশ করে দেয়। একদিন রাজার ভুল ভাঙে। তত দিনে পাখিটা মারা যায়। রাজার ভাগিনারা বলে, “পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।” 

শব্দার্থ তনখা-বেতন; টাকা; মুদ্রা। স্যাকরা—স্বর্ণকার; সােনারু। ঢাক—সুপরিচিত বৃহৎ বাদ্যযন্ত্র, ঢক্কা। তুরী-বাদ্যযন্ত্র বিশেষ; রণশিঙ্গা; বিউগল। দামামা-ঢাক জাতীয় রণবাদ্য।তলব করা -ডেকে পাঠানাে। লােকসান-ক্ষতি; অর্থনাশ; অর্থহানি; অপচয়। কাড়া-নাকাড়া-ঢাক জাতীয় বিবিধ বাদ্যযন্ত্র। অবিদ্যা—অজ্ঞান; মায়া। (অবিদ্যা পাঁচ প্রকারের, যথা-তম; মােহ; মােহামােহ; তামিস্র এবং অন্ধতমিস্র)। দক্ষিণা-হিন্দুসমাজে ক্রিয়াকর্মের শেষে পুরােহিত, গুরু, ব্রাহ্মণ প্রভৃতিকে দেওয়া অর্থ বা পারিশ্রমিক। বখশিশ—পুরস্কার; ইনাম; পারিতােষিক। লিপিকর-যারা পুঁথি লেখে; লেখক; নকলনবিশ। খবরদারি-তত্ত্বাবধান। অমাত্য-মন্ত্রী; মন্ত্রণাদাতা। দেউড়ি বাড়ির প্রধান প্রবেশদ্বার; সদর দরজা।

সৃজনশীল প্রশ্ন মনির সাহেবের একমাত্র সন্তান অমিত সে প্রচণ্ড অলস, অকর্মণ্য পড়াশােনায় মনােযােগ নেই। কিন্তু বাবার ইচ্ছা ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করা। ছেলেকে বিদ্যা শেখানাের জন্য অনেক শিক্ষক নিয়ােগ দেওয়া হলাে, অসংখ্য বই-পত্র, দিস্তা দিস্তা কাগজ-কলম এনে জড়াে করা হলাে। নামকরা বিদ্যালয়ে ভর্তি করানাে হলাে। বিদ্যালয়ে যাতায়াতের জন্য গাড়ি কেনা হলাে। সবাই মনির সাহেবের প্রশংসা করতে লাগলাে।
ক, ব্লাজী লিন্দুককে কী দিতে বলে দিলেন?
খ. ‘পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে'- একথা কেন বলা হয়েছে?
গ, তােতা কাহিনী গল্পের কোন দিকটি মনির সাহেবের চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
ঘ.উদ্দীপকে বর্ণিত শিক্ষা নিয়ে বাড়াবাড়ির দিকটি ‘তােতা কাহিনী’গল্পের আলােকে মূল্যায়ন কর ।


Post a Comment

0 Comments