আদুভাই -আবুল মনসুর আহমদ


এক 
আদুভাই ক্লাস সেভেনে পড়তেন। ঠিক পড়তেন না বলে পড়ে থাকতেন বলাই ভালাে। কারণ ঐ বিশেষ শ্রেণি ব্যতীত আর কোনাে শ্রেণিতে তিনি কখনাে পড়েছেন কি না, পড়ে থাকলে ঠিক কবে পড়েছেন, সে-কথা ছাত্ররা কেউ জানত না। শিক্ষকরাও অনেকে জানতেন না বলেই বােধ হতাে।

শিক্ষকরাও অনেকে তাঁকে ‘আদুভাই' বলে ডাকতেন। কারণ নাকি এই যে, তারাও এককালে আদুভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন এবং সবাই নাকি ক্লাস সেভেনেই আদুভাইয়ের সঙ্গে পড়েছেন। 

আমি যখন ক্লাস সেভেনে আদুভাইয়ের সহপাঠী হলাম তত দিনে আদুভাই ঐ শ্রেণির পুরাতন টেবিল-ব্ল্যাকবাের্ডের মতােই নিতান্ত অবিচেছদ্য এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক অঙ্গে পরিণত হয়ে গিয়েছেন।

আদুভাইয়ের এই অসাফল্যে আর যে-ই যত হতাশ হােক, আদুভাইকে কেউ কখনাে বিষন্ন দেখেনি। কিম্বা নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি কখনাে কোনাে শিক্ষক বা পরীক্ষককে অনুরােধ করেননি। যদি কখনাে কোনাে বন্ধ বলেছে ; যান না আদুভাই, যে কয় সাবজেক্টে শর্ট আছে, শিক্ষকদের বলে কয়ে নম্বরটা নিন না বাড়িয়ে। তখন গভীরভাবে আদুভাই জবাব দিয়েছেন, সব সাবজেক্টে পাকা হয়ে ওঠাই ভালাে। 

কোন কোন সাবজেক্টে শর্ট, সুতরাং পাকা হওয়ার প্রয়ােজন আছে, তা কেউ জানত না। আদুভাইও জানতেন না; জানবার কোনাে চেষ্টাও করেননি; জানবার আগ্রহও যে তার আছে, তাও বােঝবার উপায় ছিল না। বরং তিনি যেন মনে করতেন, ও রকম আগ্রহ প্রকাশ করাই অন্যায় ও অসঙ্গত। তিনি বলতেন, যেদিন তিনি সব সাবজেক্টে পাকা হবেন, প্রমােশন সেদিন তার কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। সে শুভ দিন যে একদিন আসবেই সে-বিষয়ে আদুভাইয়ের এতটুকু সন্দেহ কেউ কখনাে দেখেনি।

কত খারাপ ছাত্র প্রশ্নপত্র চুরি করে অপরের খাতা নকল করে আদুভাইয়ের ঘাড়ের উপর দিয়ে প্রমােশন নিয়ে চলে গিয়েছে, এ ধরনের ইঙ্গিত আদুভাইয়ের কাছে কেউ করলে, তিনি গর্জে উঠে বলতেন, জ্ঞানলাভের জন্যই আমরা স্কুলে পড়ি, প্রমােশন লাভের জন্য পড়ি না। 

সে জন্য অনেক সন্দেহবাদী বন্ধু আদুভাইকে জিজ্ঞেস করেছে, আদুভাই, আপনার কী সত্যিই প্রমােশনের আশা আছে? 

নিশ্চিত বিজয়গৌরবে আদুভাইয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তিনি তাচ্ছিল্যভরে বলেছেন, আজ হােক, কাল হােক, প্রমােশন আমাকে দিতেই হবে। তবে হ্যা, উন্নতি আতে আসেত হওয়াই ভালাে। যে গাছ লকলক করে বেড়েছে, সামান্য বাতাসেই তার ডগা ভেঙেছে। 

সেজন্য আদুভাইকে কেউ কখনাে পিছনের বেঞ্চিতে বসতে দেখেনি। সামনের বেঞ্চিতে বসে তিনি শিক্ষকদের প্রতিটি কথা মনােযােগ দিয়ে শুনতেন, হাঁ করে গিলতেন, মাথা নাড়তেন ও প্রয়ােজনমতাে নােট করতেন। খাতার সংখ্যা ও সাইজে আদুভাই ছিলেন ক্লাসের একজন অন্যতম ভালাে ছাত্র। 

শুধু ক্লাসের নয়, স্কুলের মধ্যে তিনি সবার আগে পৌঁছাতেন। এ ব্যাপারে শিক্ষক কি ছাত্ৰ-কেউ তাঁকে কোনােদিন হারাতে পেরেছে বলে শােনা যায়নি।

স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় আদুভাইকে আমরা বরাবর দুটো পুরস্কার পেতে দেখেছি। আমরা শুনেছি, আদুভাই কোন অনাদিকাল থেকে ঐ দুটো পুরস্কার পেয়ে আসছেন। তার একটি, কুল কামাই না করার জন্য; অপরটি সচ্চরিত্রতার জন্য। শহরতলির পাড়া-গাঁ থেকে রােজ রােজ পাঁচ মাইল রাস্তা তিনি হেঁটে আসতেন বটে; কিন্তু ঝড়-তুফান, অসুখ-বিসুখ কিছুই তার এ কাজের অসুবিধে সৃষ্টি করে উঠতে পারেনি। চৈত্রের কালবােশেখি বা শ্রাবণের ঋড়ঝায় যেদিন পশুপক্ষীও ঘর থেকে বেরােয়নি নিচে নুড়িমুড়ি হয়ে, বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আদুভাইকে স্কুলের পথে এগােতে দেখা গিয়েছে। মাইনের মমতায় শিক্ষকরা অবশ্য স্কুলে আসতেন। তেমন দুর্যোগে ছাত্ররা কেউ আসেনি নিশ্চিত জেনেও নিয়ম রক্ষার জন্য তারা ক্লাসে একটি উঁকি মারতেন। কিন্তু তেমন দিনেও অন্ধকার কোণ থেকে ‘আদাব, স্যার বলে যে-একটি ছাত্র শিক্ষকদের চমকিয়ে দিতেন, তিনি ছিলেন আদুভাই। আর চরিত্র? আদুভাইকে কেউ কখনাে রাগ কিংবা অভদ্রতা করতে কিংবা মিছে কথা বলতে দেখেনি।


স্কুলে ভর্তি হবার পর প্রথম পরীক্ষাতেই আমি ফাস্ট হলাম। সুতরাং আইনত আমি ক্লাসের মধ্যে সবচাইতে ভালো ছাত্র এবং আদুভাই সবার চাইতে খারাপ ছাত্র ছিলেন। কিন্তু কী জানি কেন, আমাদের দুজনার মধ্যে একটা বন্ধন সৃষ্টি হলাে। আদুভাই প্রথম থেকেই আমাকে যেন নিতান্ত আপনার লােক বলে ধরে নিলেন। আমার ওপর যেন তার কতকালের দাবি। 

আদুভাই মনে করতেন, তিনি কবি ও বক্তা। স্কুলের সাপ্তাহিক সভায় তিনি বক্তৃতা ও স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন। তাঁর কবিতা শুনে সবাই হাসত। সে হাসিতে আদুভাই লজ্জাবােধ করতেন না, নিরুৎসাহও হতেন । বরঞ্চ তাকে তিনি প্রশংসাসূচক হাসিই মনে করতেন। তার উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে যেত। 

অন্যসব ব্যাপারে আদুভাইকে বুদ্ধিমান বলেই মনে হতাে। কিন্তু এই একটি ব্যাপারে তাঁর নির্বুদ্ধিতা দেখে আমি দুঃখিত হতাম। তার নির্বুদ্ধিতা নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক সবাই তামাশা করছেন, অথচ তিনি তা বুঝতে পারছেন না, দেখে আমার মন আদুভাইয়ের পক্ষপাতী হয়ে উঠত। 

গেল এইভাবে চার বছর। আমি ম্যাট্রিকের জন্য টেস্ট পরীক্ষা দিলাম। আদুভাই কিন্তু সেবারও যথারীতি ক্লাস সেভেনেই অবস্থান করছিলেন। 


দুই
ডিসেম্বর মাস । 

সব ক্লাসের পরীক্ষা ও প্রমােশন হয়ে গিয়েছে। প্রথম বিবেচনা, দ্বিতীয় বিবেচনা, তৃতীয় বিবেচনা ও বিশেষ বিবেচনা ইত্যাদি সকল প্রকারের বিবেচনা হয়ে গিয়েছে। বিবেচিত প্রমােশন-প্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য বারের ন্যায় সেবারও পাস-করা প্রমােশন-প্রান্তের সংখ্যার দ্বিগুণেরও উর্ধ্বে উঠেছে। 

কিন্তু আদুভাই এসব বিবেচনার বাইরে। কাজেই তার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে আমরা টিউটরিয়েল ক্লাস করছিলাম। ছাত্ররা শুধু শুধু স্কুলপ্রাঙ্গণে জটলা করছিল-প্রমােশন পাওয়া ছেলেরা নিজেদের কীর্তি-উজ্জ্বল চেহারা দেখাবার জন্য, আর না-পাওয়া ছেলেরা প্রমােশনের কোনাে প্রকার অতিরিক্ত বিশেষ বিবেচনার দাবি জানাবার জন্য। 

এমন দিনে একটু নিরালা জায়গায় পেয়ে হঠাৎ আদুভাই আমার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। আমি চমকে উঠলাম। আদুভাইকে আমরা সবাই মুরব্বি মানতাম। তাই তাকে ক্ষিপ্রহতে টেনে তুলে প্রতিদানে তাঁর পা ছুঁয়ে বললাম, কী হয়েছে আদুভাই, অমন পাগলামি করলেন কেন? 

আদুভাই কম্পিত কণ্ঠে বললেন, প্রমােশন। 
আমি বিস্মিত হলাম; বললাম, প্রমােশন? প্রমােশন কী? আপনি প্রমােশন পেয়েছেন? 
: না, আমি প্রমােশন পেতে চাই। 
: ও, পেতে চান? সে তাে সবাই চায়। 

আদুভাই অপরাধীর ন্যায় উদ্বেগ-কম্পিত ও সংকোচ-জড়িত প্যাচ-মােচড় দিয়ে যা বললেন, তার মর্ম এই যে, প্রমােশনের জন্য এত দিন তিনি কারও কাছে কিছু বলেননি; কারণ, প্রমােশন জিনিসটাকে যথাসময়ের পূর্বে এগিয়ে আনাটা তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে এবার তাকে প্রমােশন পেতেই হবে। সে নির্জনতায়ও তিনি আমার কানের কাছে মুখ এনে সেই কারণটি বললেন। তা এই যে, আদুভাইর ছেলে সেবার ক্লাস সেভেনে প্রমােশন পেয়েছে। নিজের ছেলের প্রতি আদুভাইয়ের কোনাে ঈর্ষা নেই। কাজেই ছেলের সঙ্গে এক শ্রেণিতে পড়ার তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু আদুভাইয়ের স্ত্রীর তাতে ঘােরতর আপত্তি আছে। ফলে, হয় আদুভাইকে এবার প্রমােশন পেতে হবে, নয়তাে পড়াশােনা ছেড়ে দিতে হবে। পড়াশােনা ছেড়ে দিয়ে আদুভাই বাঁচবেন কী নিয়ে? 

আমি আদুভাইয়ের বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারলাম। তার অনুরােধে আমি শিক্ষকদের কাছে সুপারিশ করতে যেতে রাজি হলাম। 

প্রথমে ফারসি শিক্ষকের কাছে যাওয়া স্থির করলাম। কারণ, তিনি একদা আমাকে মােট একশত নম্বরের মধ্যে একশত পাঁচ নম্বর দিয়েছিলেন। বিস্মিত হেডমাস্টার তার কারণ জিজ্ঞেস করায় মৌলবি সাব বলেছিলেন, ‘ছেলে সমস্ত প্রশ্নের শুদ্ধ উত্তর দেওয়ায় সে পূর্ণ নম্বর পেয়েছে। পূর্ণ নম্বর পাওয়ার পুরস্কার স্বরূপ আমি খুশি হয়ে তাকে পাঁচ নম্বর বখশিশ দিয়েছি। অনেক তর্ক করেও হেডমাস্টার মৌলবি সাবকে এই কাজের অসঙ্গতি বােঝতে পারেননি। 

মৌলবি সাব আদুভাইয়ের নাম শুনে জ্বলে উঠলেন। অমন বেতমিজ ও খােদার না-ফরমান বান্দা তিনি কখনাে দেখেননি বলে আস্ফালন করলেন এবং অবশেষে টিনের বাক্স থেকে অনেক খুঁজে আদুভাইয়ের খাতা বের করে আমার সামনে ফেলে দিয়ে বললেন, দেখ। 

আমি দেখলাম, আদুভাই মােটে তিন নম্বর পেয়েছে। তবু হতাশ হলাম না। পাসের নম্বর দেওয়ার জন্য তাঁকে চেপে ধরলাম। 

বড় দেরি হয়ে গিয়েছে, নম্বর সাবমিট করে ফেলেছেন, বিবেচনার তর পার হয়ে গিয়েছে ইত্যাদি সমত যুক্তির আমি সন্তোষজনক জবাব দিলাম। তিনি বললেন, তুমি কার জন্য, কী অন্যায় অনুরােধ করছ; খাতাটা খুলেই একবার দেখ না। 

আমি মৌলবি সাবকে খুশি করবার জন্য অনিচছাসত্ত্বেও এবং অনাবশ্যক বােধেও খাতাটা খুললাম। দেখলাম : ফারসি পরীক্ষা বটে, কিন্তু খাতার কোথাও একটি ফারসি হরফ নেই। তার বদলে ঠাসবুনানাে বাংলা হরফে অনেক কিছু লেখা আছে। কৌতূহলবশে পড়ে দেখলাম : এই বঙ্গদেশে ফারসি ভাষা আমদানির অনাবশ্যকতা ও ছেলেদের তা শিখবার চেষ্টার মূখতা সম্বন্ধে আদুভাই যুক্তিপূর্ণ একটি থিসিস’ লিখে ফেলেছেন। 

পড়া শেষ করে মৌলবি সাবের মুখের দিকে চাইতেই বিজয়ের ভঙ্গিতে বললেন, দেখেছ বাবা বেতমিজের কাজ? আমি নিতান্ত ভালাে মানুষ বলেই তিনটে নম্বর দিয়েছি, অন্য কেউ হলে রাসটিকেটের সুপারিশ করত। 

যা হােক, শেষ পর্যন্ত মৌলবি সাব আমার অনুরােধ এড়াতে পারলেন না। খাতার উপর ৩-এর পৃষ্ঠে ৩ বসিয়ে ৩৩ করে দিলেন। 

আমি বিপুল আনন্দে অঙ্কের পরীক্ষকের বাড়ি ছুটলাম।। 

সেখানে আদুভাইয়ের খাতার উপর লাল পেন্সিলের একটি প্রকাণ্ড ভূমণ্ডল আঁকা রয়েছে। ব্যাপারের গুরুত্ব বুঝেও আমার উদ্দেশ্য বললাম। অঙ্কের মাস্টার তাে হেসেই খুন। হাসতে-হাসতে তিনি আদুভাইয়ের খাতা বের করে আমাকে অংশবিশেষ পড়ে শােনালেন। তাতে আদুভাই লিখেছেন যে, প্রশ্নকর্তা ভালাে ভালাে অঙ্কের প্রশ্ন ফেলে কতকগুলাে বাজে ও অনাবশ্যক প্রশ্ন করেছেন। সেজন্য এবং প্রশ্নকর্তার ত্রুটি সংশােধনের উদ্দেশ্যে আদুভাই। নিজেই কতিপয় উৎকৃষ্ট প্রশ্ন লিখে তার বিশুদ্ধ উত্তর দিচ্ছে-এইরূপ ভূমিকা করে আদুভাই যে-সমত অঙ্ক করেছেন, শিক্ষক মহাশয় প্রশ্নপত্র ও খাতা মিলিয়ে আমাকে দেখালেন যে, প্রশ্নের সঙ্গে আদুভাইর উত্তরের সত্যিই কোনাে সংস্রব নেই।

প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিল থাক আর না থাক; খাতায় লেখা অঙ্ক শুদ্ধ হলেই নম্বর পাওয়া উচিত বলে আমি শিক্ষকের সঙ্গে অনেক ধস্তাধসিত করলাম। শিক্ষক মশায়, যাহােক, প্রমাণ করে দিলেন যে, তাও শুদ্ধ হয়নি। 

সুতরাং পাসের নম্বর দিতে তিনি রাজি হলেন না। তবে তিনি আমাকে এই আশ্বাস দিলেন যে, অন্য সব সাবজেক্টের শিক্ষকদের রাজি করাতে পারলে তিনি আদুভাইয়ের প্রমােশনে সুপারিশ করতে প্রস্তুত আছেন। 

নিতান্ত বিষমনে অন্য পরীক্ষকদের নিকটে গেলাম। সর্বত্র অবস্থা প্রায় একরূপ। ভূগােলের খাতায় তিনি লিখেছেন যে, পৃথিবী গােলাকার এবং সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে, এমন গাঁজাখুরি গল্প তিনি বিশ্বাস করেন না। ইতিহাসের খাতায় লিখেছেন যে, কোন রাজা কোন সম্রাটের পুত্র এসব কথার কোনাে প্রমাণ নেই। ইংরেজির খাতায় তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের ছবি পাশাপাশি আঁকবার চেষ্টা করেছেন-অবশ্য কে যে সিরাজ, কে যে ক্লাইভ, নিচে লেখা না থাকলে তা বােঝা যেত না। 

হতাশ হয়ে হােস্টেলে ফিরে এলাম। আদুভাই আগ্রহ - ব্যাকুল চোখে আমার পথপানে চেয়ে অপেক্ষা করছিলেন। 

আমি ফিরে এসে নিষ্ফলতার খবর দিতেই তাঁর মুখটি ফ্যাকাশে হয়ে গেল। 

তবে আমার কী হবে ভাই? বলে তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। 

কিছু একটা করবার জন্য আমার প্রাণও ব্যাকুল হয়ে উঠল। বললাম, তবে কী আদুভাই, আমি হেডমাস্টারের কাছে যাব? 

আদুভাই ক্ষণিক আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বললেন, তুমি আমার জন্য যা করেছ, সেজন্য ধন্যবাদ। হেডমাস্টারের কাছে তােমার গিয়ে কাজ নেই। সেখানে যেতে হয় আমিই যাব। হেডমাস্টারের কাছে জীবনে আমি কিছু চাইনি। এই প্রার্থনা তিনি আমার ফেলতে পারবেন না। 

বলেই তিনি হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। 

আমি একদৃষ্টে দ্রুতগমনশীল আদুভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম। তিনি দৃষ্টির আড়াল হলে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলাম। 


তিন 

সেদিন বড়দিনের ছুটি আরম্ভ। শুধু হাজিরা লিখেই স্কুল ছুটি দেওয়া হলাে। 

আমি বাইরে এসে দেখলাম : স্কুলের গেটের সামনে একটি পােস্তার ওপর একটি উঁচু টুল চেপে তার ওপর দাড়িয়ে আদুভাই হাত-পা নেড়ে বক্তৃতা করছেন। ছাত্ররা ভিড় করে তার বক্তৃতা শুনছে এবং মাঝে মাঝে করতালি দিচেছ। 

আমি শ্রোতৃমণ্ডলীর ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। 

আদুভাই বলছিলেন, হ্যা, প্রমােশন আমি মুখফুটে কখনাে চাইনি। কিন্তু সেজন্যই কী আমাকে প্রমােশন না-দেয়া এঁদের উচিত হয়েছে? মুখফুটে না চেয়ে এত দিন আমি এঁদের আক্কেল পরীক্ষা করলাম। এঁদের মধ্যে দানাই বলে কোনাে জিনিস আছে কি না, আমি তা যাচাই করলাম। দেখলাম, বিবেচনা বলে কোনাে জিনিস এঁদের মধ্যে নেই। এঁরা নির্মম, হৃদয়হীন। একটি মানুষ যে চোখ বুজে এঁদের বিবেচনার ওপর নিজের জীবন ছেড়ে দিয়ে বসে আছে, এঁদের প্রাণ বলে কোনাে জিনিস থাকলে সে কথা কি এঁরা এত দিন ভুলে থাকতে পারতেন? 

আদুভাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি বাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে আবার বলতে লাগলেন, আমি এঁদের কাছে কী আর বিশেষ চেয়েছিলাম? শুধুমাত্র একটি প্রমােশন। তা দিলে এঁদের কী এমন লােকসান হতাে? মনে করবেন না, প্রমােশন না-দেয়ায় আমি রেগে গেছি। রাগ আমি করিনি। আমি শুধু ভাবছি, যাঁদের বুদ্ধি বিবেচনার উপর হাজার হাজার ছেলের বাপ-মা ছেলেদের জীবনের ভার দিয়ে নিশ্চিত থাকেন, তাঁদের আক্কেল কত কম। তাদের প্রাণের পরিসর কত অল্প। 

একটু দম নিয়ে আদুভাই আরম্ভ করলেন, আমি বহুকাল এই স্কুলে পড়ছি। একদিন এক পয়সা মাইনে কম দেইনি। বছর-বছর নতুন-নতুন পুতক ও খাতা কিনতে আপত্তি করিনি। ভাবুন, আমার কতগুলাে টাকা গিয়েছে। আমি যদি প্রমােশনের এতই অযােগ্য ছিলাম, তবে এই দীর্ঘদিনের মধ্যে একজন শিক্ষকও আমায় কেন বললেন না, ‘আদুমিঞা, তােমার প্রমােশনের কোনাে চান্স নেই, তােমার মাইনেটা আমরা নেব না।' মাইনে দেবার সময় কেউ বারণ করলেন না, পুস্তক কেনবার সময় কেউ নিষেধ করলেন না। শুধু প্রমােশনের বেলাতেই তাদের যত নিয়মকানুন এসে বাধল? আমি ক্লাস সেভেন পাস করতে পারলাম না বলে ক্লাস এইটেও পাস করতে পারতাম না, এই কথা এদের কে বলেছে? অনেকে ম্যাটিক-আইএ-তে কোনােমতে পাস করে বিএ এমএ - তে ফার্স্টক্লাস পেয়েছে, দৃষ্টান্ত আমি অনেক দেখাতে পারি। কোনাে কুগ্রহের ফেরেই আমি ক্লাস সেভেনে আটকে পড়েছি। একবার কোনােমতে এই ক্লাসটা ডিঙোতে পারলেই আমি ভালাে করতে পারতাম, এটা বােঝা মাস্টারবাবুদের উচিত ছিল। আমাকে একবার ক্লাস এইটে প্রমােশন দিয়ে আমার লাইফের একটা চান্স এঁরা দিলেন না! 

আদুভাইয়ের কণ্ঠরােধ হয়ে এল। তিনি খানিক থেমে ধুতির খুঁটে নাক-চোখ মুছে নিলেন। দেখলাম, শ্রোতৃগণের অনেকের গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। গলা পরিষ্কার করে আদুভাই আবার শুরু করলেন, আমি কখনাে এতসব কথা বলিনি, আজও বলতাম না। বললাম শুধু এই জন্য যে, আমার বড় ছেলে এবার ক্লাস সেভেনে প্রমােশন পেয়েছে। সে-ও এই স্কুলেই পড়ত। এই স্কুলের শিক্ষকদের বিবেচনায় আমার আস্থা নেই বলেই আমি গতবারই আমার ছেলেকে অন্য স্কুলে ট্রান্সফার করে দিয়েছিলাম। যথাসময়ে এই সতর্কতা অবলম্বন না করলে, আজ আমাকে কী অপমানের মুখে পড়তে হতাে, তা আপনারাই বিচার করুন। 

আদুভাইয়ের শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি গলায় দৃঢ়তা এনে আবার বলতে শুরু করলেন, কিন্তু আমি সত্যকে জয়যুক্ত করবই। আমি একদিন ক্লাস এইটে ••• এই সময় স্কুলের দারােয়ান এসে সভা ভেঙে দিল। আমি আদুভাইয়ের দৃষ্টি এড়িয়ে চুপে চুপে সরে পড়লাম। তারপর যেমন হয়ে থাকে-সংসার-সাগরের প্রবল স্রোতে কে কোথায় ভেসে গেলাম, কেউ জানলাম না।

চার

আমি সেবার বিএ পরীক্ষা দেব। খুব মন দিয়ে পড়ছিলাম। হঠাৎ লাল লেফাফার এক পত্ৰ পেলাম। কারও বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র হবে মনে করে খুললাম। ঝরঝরে তকতকে সােনালি হরফে ছাপা পত্র। পত্ৰলেখক আদুভাই।। তিনি লিখেছেন, তিনি সেবার ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস এইটে প্রমােশন পেয়েছেন বলে বন্ধুবান্ধবদের জন্য কিছু ডালভাতের ব্যবস্থা করেছেন। 

দেখলাম, তারিখ অনেক আগেই চলে গিয়েছে। বাড়ি ঘুরে এসেছে বলে পত্র দেরিতে পেয়েছি। ছাপচিঠির সঙ্গে হাতের লেখা একটি পত্র। আদুভাইর পুত্র লিখেছে, বাবার খুব অসুখ, আপনাকে দেখবেন তার শেষ সাধ। পড়াশােনা ফেলে ছুটে গেলাম আদুভাইকে দেখতে। এই চার বছর তাঁর কোনাে খবর নিইনি বলে লজ্জা-অনুতাপে ছােট হয়ে যাচ্ছিলাম। 

ছেলে কেঁদে বলল, বাবা মারা গিয়েছেন। প্রমােশনের জন্য তিনি এবার দিনরাত এমন পড়াশােনা শুরু করেছিলেন যে, শয্যা নিলেন তবু পড়া ছাড়লেন না। আমরা সবাই তার জীবন সম্বন্ধে ভয় পেলাম। পাড়শুদ্ধ। লােক গিয়ে হেডমাস্টারকে ধরায় তিনি স্বয়ং এসে বাবাকে প্রমােশনের আশ্বাস দিলেন। বাবা অসুখ নিয়েই পালকি চড়ে স্কুলে গিয়ে শুয়ে-শুয়ে পরীক্ষা দিলেন। আগের কথামতাে তাকে প্রমােশন দেয়া হলাে। তিনি তাঁর ‘প্রমােশন উৎসব উদ্যাপন করবার জন্য আমাকে হুকুম দিলেন। কাকে-কাকে নিমন্ত্রণ করতে হবে, তার লিস্টও তিনি নিজহাতে করে দিলেন। কিন্তু সেই উৎসবে যারা যােগ দিতে এলেন, তাঁরা সবাই তার জানাজা পড়ে বাড়ি ফিরলেন। 

আমি চোখের পানি মুছে কবরের কাছে যেতে চাইলাম। 

ছেলে আমাকে গােরতানে নিয়ে গেল। দেখলাম, আদুভাইয়ের কবরে খােদাই করা মার্বেল পাথরের ট্যাবলেটে লেখা রয়েছে : 
Here sleeps Adu Mia who was promoted 
from Class VII to Class VIII. 
ছেলে বলল, বাবার শেষ ইচ্ছামতােই ও-ব্যবস্থা করা হয়েছে। 


লেখক-পরিচিতি  - ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার অন্তর্গত ধানীখােলা গ্রামে ১৮৯৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর (১৩০৫ বঙ্গাব্দের ১৯শে ভাদ্র) এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে আবুল মনসুর আহমদ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুর রহিম ফরাযী এবং মাতার নাম মীর জাহান খাতুন। ধানীখােলা গ্রামে ফরাযী-পরিবারকে ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারক বলে মনে করা হতাে। গ্রামের অধিকাংশ জনসাধারণই ছিলেন গোঁড়া মুহম্মদি সম্প্রদায়ভুক্ত। এমনই এক ধর্মীয় কড়াকড়ি পারিবারিক ঐতিহ্যের মধ্যে তার শৈশব ও কৈশাের কেটেছে। তার শিক্ষাজীবনের শুরু হয় পাঁচ বছর বয়সে চাচা মুনসি ছমিরুদ্দিনের মক্তবে বাগদাদি কায়দা, আম-সিপারা ও কোরআন মজিদের মাধ্যমে। ১৯০৬ সালে তিনি জমিদার কাছারিতে পাঠশালায় ভর্তি হন। 

১৯০৮ সাল পর্যন্ত এখানে পড়াশােনা শেষে ১৯০৯ সালে দরিরামপুর মাইনর স্কুলে ভর্তি হন। এখানে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এরপর ১৯১৩ সালের জানুয়ারি মাসে নাসিরাবাদ শহরের মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। এ স্কুল থেকে ১৯১৭ সালে পাঁচ টাকা মুহসীন বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯১৯ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯২৯ সালে কলকাতার রিপন ল কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ল পাস করেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। তার লেখা খ্যাতনামা গ্রন্থগুলাে হলাে : তুজুর কেবলা, নয়াপাড়া, ‘আয়না’, ‘আসমানী পর্দা’, ‘ফুড কনফারেন্স’, ‘গালিভারের সফরনামা' ইত্যাদি। ১৯৭৯ সালের ১৮ই মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সার-সংক্ষেপ -আদুভাই নামে এক ছাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ত। পড়ালেখায় সে ভালাে না হলেও চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, আদব-কায়দায় ছিল সবার উপরে। বিদ্যালয়ের নিয়মকানুন সবসময় মেনে চলত। কিন্তু সে কখনােই বার্ষিক পরীক্ষায় পাস করতে পারত না। ফলে বছরের পর বছর সে ক্লাস সেভেনেই থাকত। তার সহপাঠীরা পাস করে কেউ কেউ ঐ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। কেউ অন্যত্র ভালাে চাকরি করছে। কিন্তু আদুভাই ঐ ক্লাস সেভেনেই পড়ে আছে। সে প্রমােশনের জন্য কারও কাছে কোনাে দিন আবেদন করেনি। কিন্তু একদিন দেখা গেল সে প্রমােশনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। কারণ সে-বছর তার ছেলেও ক্লাস সেভেনে প্রমােশন পেয়েছে। তার শ্রীর আপত্তির কারণে সে প্রমােশন পেতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। এর কিছুদিন পর আদুভাই কঠোর পরিশ্রম করে দিনরাত পড়াশােনা করে অষ্টম শ্রেণিতে প্রমােশন পেয়েছিল। কিন্তু অতিরিক্ত খাটুনির ফলে শরীরে শক্ত রােগ বাসা বাঁধে। ফলে কিছুদিন পরেই আদুভাই মারা যায়। 

শব্দার্থ ও টীকা তাচ্ছিল্য - তুচ্ছ জ্ঞান; অশ্রদ্ধা; অবজ্ঞা। অনাদিকাল - আদিকাল থেকে; বহুকাল ধরে। নির্বুদ্ধিতা -- বিশেষ জ্ঞান নেই এমন; নির্বোধ। থিসিস-- নিবন্ধ; অভিসন্দর্ভ। বেতমিজ - অশিষ্ট; বেয়াদব; শিষ্টাচারজ্ঞানবর্জিত। ভূমণ্ডল - পৃথিবী; ভূভাগ। সংস্রব - সংযােগ; সম্পর্ক সম্বদ্ধ। পরীক্ষক - পরীক্ষা করে এমন; পরীক্ষাকারী। ফ্যাকাশে- বিবর্ণ; পাণ্ডুবর্ণ; অনুজ্জ্বল; দীপ্তিহীন। 

Post a Comment

0 Comments