দুরন্ত এক কিশাের। নাম নূর মােহাম্মদ শেখ। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। নাটক, থিয়েটার আর গানের প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ। কিশাের। বয়সে হঠাৎ করে তার বাবা-মা মারা গেলেন। বদলে গেল তার জীবন। যােগ দিলেন ইপিআর-এ অর্থাৎইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ। সময়টা ১৯৭১ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর। যশােরের পাকিস্তানি ছুটিপুর ক্যাম্প। একটু দুরে গােয়ালহাটি গ্রামে টহল দিচ্ছিলেন পাঁচ মুক্তিযােদ্ধা। এঁদেরই নেতৃত্বে ছিলেন ল্যান্সনায়েক নূর মােহাম্মদ শেখ। পাকিস্তানি সেনারা টের পেয়ে যায় মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান। রাজাকারদের সহায়তায় তিন দিক থেকে পাকিস্তানি সেনারা তাদের ঘিরে ফেলে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা দমবার পাত্র নন। এই দলেই ছিলেন অসীম সাহসী মুক্তিযােদ্ধা নানু মিয়া। কিন্তু প্রতিপক্ষের একটা গুলি হঠাৎ এসে লাগে তার গায়ে। নুর মােহাম্মদ তাঁকে এক হাত দিয়ে কাঁধে তুলে নিলেন আর অন্য হাত দিয়ে গুলি চালাতে থাকলেন। কৌশল হিসেবে বারবার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকলেন তিনি। উদ্দেশ্য- একজন নন, অনেক মুক্তিযােদ্ধা যুদ্ধ করছেন, শত্রুদের এরকম একটা ধারণা দেওয়া। সংখ্যায় কম বলে সহযােদ্ধাদের নির্দেশ দিলেন পিছিয়ে গিয়ে অবস্থান নিতে। কিন্তু হঠাৎ মর্টারের একটা গােলা এসে লাগল তাঁর পায়ে। গােলার আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল তার পা। তিনি বুঝতে পারলেন মৃত্যু আসন্ন। যতক্ষণ সম্ভব গুলি চালাতে চালাতে তিনি শহিদ হলেন। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে নূর মােহাম্মদ শেখ এভাবেই রক্ষা করেছিলেন মুক্তিযােদ্ধাদের জীবন। সাহসী এই বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযােদ্ধর জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি নড়াইলের মহিষখােলা গ্রামে। এরকমই আরেক যােদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফ। ১৯৪৩ সালের ৮ই মে ফরিদপুর জেলার বােয়ালমারী থানার সালামতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায়। দারুণ দুরন্ত ছিলেন। তিনিও ইপিআর বাহিনীতে যােগ দেন। মেশিন-চালক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি। সৈনিকদের মতাে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
দিনটি ছিল একাত্তরের ৮ই এপ্রিল। ঐদিন মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি নৌসেনাদের উপর আক্রমণ করবে। এজন্যে তাঁরা মহালছড়ির কাছে বুড়িঘাট এলাকার চিংড়ি খালের দুই পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ করতে এগিয়ে আসে। সাথে নিয়ে আসে। সাতটি স্পিডবােট আর দুটি মােটর লঞ্চ। স্বল্পসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধার মৃত্যু ছিল অবধারিত। তবু মুক্তিযােদ্ধারা পালিয়ে যাননি। আবদুর রউফ নিজেই দায়িত্ব নিলেন নিজের জীবন দিয়ে সবাইকে রক্ষা করার। হালকা একটা মেশিনগান হাতে তুলে নিয়ে গুলি ছুঁড়ে শত্রুদের রুখে দিতে থাকলেন। সহযােদ্ধাদের বললেন নিরাপদে সরে যেতে। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানিদের সাতটি স্পিডবােটই ডুবে গেল। বাকি লঞ্চ দুটো থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা পিছু হটতে থাকল। এ রকম মুহুর্তেই হঠাৎএকটা গােলা এসে পড়ল তার উপর, তিনি শহিদ হলেন। বীরের রক্তস্রোতে রঞ্জিত হলাে মাটি। রাঙামাটি জেলার বাের্ড বাজারের কাছে নানিয়ারচরের চিংড়িখালের কাছাকাছি একটি টিলার উপর সমাহিত হন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ। পরবর্তী সময়ে সমাধিকে স্মৃতিস্তম্ভে রূপান্তরিত করে সরকার।
একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রুিদ্ধে কতভাবেই না যুদ্ধ করতে হয়েছিল আমাদের। এই যুদ্ধে জয়ী বাহিনী হিসেবে মুক্তিযােদ্ধারা বয়ে এনেছেন অসীম গৌরব। এ রকমই এক যুদ্ধে শহিদ হন বীরশ্রেষ্ঠ মােহাম্মদ রুহুল আমিন। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ। মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে আমরা। মুক্তিযােদ্ধাদের নৌজাহাজ বিএনএস পলাশ এবং বিএনএস পদ্ম মংলা বন্দর দখল করে নিয়েছে। এবার খুলনা দখলই লক্ষ্য। ভৈরব নদী বেয়ে খুলনার দিকে ধেয়ে আসছেন তারা। জাহাজ দুটি খুলনার কাছাকাছি চলে আসে। এমন সময় একটা বােমারু বিমান থেকে জাহাজ দুটির ওপর বােমা এসে পড়ে। রুহুল আমিন বিএনএস পলাশের ইঞ্জিনরুমে ছিলেন। ইঞ্জিনরুমের ওপরে বােমা পড়েছিল। ইঞ্জিন বিকল হয়ে আগুন ধরে গিয়েছিল পলাশে। তার ডান হাতটি উড়ে গিয়েছিল। তিনি আহত অবস্থায় ঝাপ দিয়ে নদী সাঁতরে পাড়ে উঠলেন। বােমার আঘাত থেকে তিনি রক্ষা পেলেন। কিন্তু রাজাকারদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যু হলাে তাঁর। তিনি শহিদ হলেন। খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই বীর মুক্তিযােদ্ধা। এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ আজ মুক্ত। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন। করি। দেশের এ বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য গবির্ত আমরা।
প্রশ্নগুলাের উত্তর বলি ও লিখি।
ক. নূর মােহাম্মদ শেখ কীভাবে নিজের জীবন তুচ্ছ করে মুক্তিযােদ্ধাদের জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন?
খ. ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফের যুদ্ধের ঘটনাটা লিখি।
গ. বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন কীভাবে শহিদ হয়েছিলেন?
ঘ. গল্প থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরযােদ্ধাদের সম্পর্কে যা জেনেছি তা নিজের ভাষায় লিখি।
0 Comments