ফুটবল খেলােয়াড় - জসীমউদদীন


আমাদের মেসে ইমদাদ হক ফুটবল খেলােয়াড়, 
হাতে পায়ে মুখে শত আঘাতের ক্ষতে খ্যাতি লেখা তার। 
সন্ধ্যাবেলায় দেখিবে তাহারে পটি বাধি পায়ে হাতে, 
মালিশ মাখিছে প্রতি গিটে গিটে কাত হয়ে বিছানাতে। 
মেসের চাকর হয় লবেজান সেঁক দিতে ভাঙা হাড়ে, 
সারা রাত শুধু ছটফট করে কেঁদে কেঁদে ডাক ছাড়ে। 
আমরা তাে ভাবি ছমাসের তরে পঙ্গ সে হলাে হায়, 
ফুটবল-টিমে বল লয়ে কভু দেখিতে পাব না তায়। 

প্রভাত বেলায় খবর লইতে ছুটে যাই তার ঘরে, 
বিছানা তাহার শূন্য পড়িয়া ভাঙা খাটিয়ার পরে। 
টেবিলের পরে ছােট বড় যত মালিশের শিশিগুলি, 
উপহাস যেন করিতেছে মােরে ছিপি-পরা দাঁত তুলি। 
সন্ধ্যাবেলায় খেলার মাঠেতে চেয়ে দেখি বিয়ে, 
মােদের মেসের ইমদাদ হক আগে ছুটে বল লয়ে। 

বাম পায়ে বল ড্রিবলিং করে ডান পায়ে মারে ঠেলা, 
ভাঙা কয়খানা হাতে পায়ে তার বন্ধু করিছে খেলা। 
চালাও চালাও আরাে আগে যাও বাতাসের আগে ধাও, 
মারাে জোরে মারাে-গােলের ভিতরে বলেরে ঘঁড়িয়া দাও। 
গােল-গােল-গােল, চারদিক হতে ওঠে কোলাহলকল, জীবনের পণ, 
মরণের পণ, সব বাধা পায়ে দল। 

গােল-গােল-গােল-মােদের মেসের ইমদাদ হক কাজি, 
ভাঙা দুটি পায়ে জয়ের ভাগ্য লুটিয়া আনিল আজি। 
দর্শকদল ফিরিয়া চলেছে মহা-কলরব করে, 
ইমদাদ হক খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসে যে মেসের ঘরে। 
মেসের চাকর হয়রান হয় পায়েতে মালিশ মাখি, 
বেঘুম রাত্র কেটে যায় তার চিৎকার করি ডাকি। 
সকালে সকলে দৈনিক খুলি মহা-কলরবে পড়ে, 
ইমদাদ হক কাল যা খেলেছে কমই তা নজরে পড়ে।

কবিতাটির মূলভাব জেনে নিই। 
জাত খেলােয়াড় ইমদাদ হক। খেলা এবং খেলায় জেতাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। নিজের অবস্থা যেমনই হােক না কেন খেলা-পাগল সে, খেলবেই। খেলতে গিয়ে ইমদাদ কত শত আঘাত পায়। তবু সেসব কষ্টকে পরােয়া না করে সে খেলে এবং তার জন্যই। খেলায় জিত আসে। তার জন্যই সকল দর্শক খেলার আনন্দ পায়। এই কবিতায় খেলাচ্ছলে একটি আদর্শকে তুলে ধরা হয়েছে। তা হলাে, নিজের যােগ্যতার সবটুকু দিয়ে মানুষ যদি একান্তভাবে কিছু করে, তবে অন্য সকলের জন্যও সে বড় কিছু করতে পারে।

কবি-পরিচিতি কবি জসীমউদ্দীন ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মতারিখ ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি। গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতায় পল্লিজীবন বেশি উঠে এসেছে বলে তিনি ‘পল্লিকবি’ নামে খ্যাত হয়েছেন। তবে জসীমউদদীন। ছােটদের জন্যও অনেক সুন্দর কবিতা ও গদ্য রচনা করেছেন। তাঁর লেখা ভ্রমণকাহিনি ও আত্মজীবনী অত্যন্ত সুন্দর। তাঁর কবিতা ‘কবর’, কাব্যগ্রন্থ ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সােজন। বাদিয়ার ঘাট’, ছােটদের জন্য লেখা ‘ডালিম কুমার’, ‘হাসু ও ‘এক পয়সার বাঁশি’ বিখ্যাত। তিনি ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। 

Post a Comment

0 Comments