স্বরণীয় যাঁরা চিরদিন


৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন আমরা দেশকে পুরােপুরি শত্রুমুক্ত করে বিজয় অর্জন করি। এই বিজয়কে পাওয়ার আগে দেশবাসীকে করতে হয় এক মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের সাহসী বীর মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে৷ দেশের অন্য সব সাধারণ মানুষ তাদের জুগিয়েছেন ভরসা ও সাহস। অপেক্ষা করেছেন শত্রুর হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়ার। সশস্ত্র যুদ্ধে আমাদের মুক্তিসেনারা প্রাণ দেন। আর দেশের ভিতরে অবরুদ্ধ জীবনযাপন করতে করতে প্রাণ দেন এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। তারা ছিলেন নানা পেশার-কেউ ছাত্র, কেউ কৃষক, কেউ মজুর, কেউ পুলিশ, কেউ সৈনিক। আরও ছিলেন শিক্ষক, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা ও নানা পেশার লােক। লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশুর রক্তে ভেজা আমাদের স্বাধীনতা। তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা আজ মুক্ত স্বাধীন দেশে উন্নত শিরে জীবনযাপন করতে পারছি। আমরা । কৃতজ্ঞ তাদের কাছে। সেই অসংখ্য মহান আত্মদানকারীদের কয়েকজনের কথা আমরা জেনে নিব। 

১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানি সেনারা গভীর রাতে ঝাপিয়ে পড়ে ঢাকার নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষের ওপর। আক্রমণ চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে, ব্যারাকে, আর নানা আবাসিক এলাকায়। নির্বিচারে হত্যা করে ঘুমন্ত মানুষকে। সেই হত্যাকান্ড চালিয়ে যেতে থাকে বিরামহীন। চালিয়ে যেতে থাকে পরবর্তী নয় মাস ধরে। পাশাপাশি তারা বিশেষ রকমের হত্যাকাণ্ড চালানাের পরিকল্পনাও করে। সেই পরিকল্পনা অনুসারে একে একে হত্যা করে এদেশের মেধাবী, আলােকিত ও বরেণ্য মানুষদের। পুরাে দেশের নানা পেশার মেধাবী ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে তারা। হত্যা পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য পাকিস্তানিরা গড়ে তােলে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। পাষণ্ড কিছু লােকজন যােগ দেয় ওই সব বাহিনীতে। তারা পাকিস্তানি সেনাদের ওই হত্যা পরিকল্পনায় সহযােগিতা করে। 

পঁচিশে মার্চের মধ্যরাতে শহিদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনষী শিক্ষক এম.মুনিরুজ্জামান, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. গােবিন্দচন্দ্র দেব। পাকিস্তানি সেনারা সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলােতেই শুধু আক্রমণ চালায়নি, হানা দেয় তারা শিক্ষকদের বাড়িতে বাড়িতেও। বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন এম. মুনিরুজ্জামান। প্রচণ্ড গােলাগুলির শব্দ শুনে তিনি পবিত্র কুরআন পড়া শুরু করেন। এই কুরআন পাঠরত মানুষটিকেই টেনে হিচড়ে নিচে নামায় পাকিস্তানি সেনারা। একই বাড়ির নিচতলায় থাকতেন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। ইংরেজি। সাহিত্যের খ্যাতিমান শিক্ষক। তাঁকেও শত্রুসেনারা টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে। তারপর এই দুই শিক্ষককেই গুলি করে হত্যা করে। এ বাড়ির খুব কাছেই এক বাসায় থাকতেন অধ্যাপক গােবিন্দচন্দ্র দেব। দর্শনশাস্ট্রের যশস্বী শিক্ষক ছিলেন তিনি। মানুষ হিসেবে ছিলেন খুব সহজ সরল আর নিরহংকার। ওই একই রাতে তাকেও হত্যা করে তারা। হত্যা করে আরও কয়েকজন শিক্ষককে।

পঁচিশে মার্চ রাতে আক্রান্ত হয় সংবাদপত্র অফিসগুলােও। প্রধান সংবাদপত্রগুলাের অনেক অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা সেই রাতে। হত্যা করে বহু সাংবাদিককে। পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা দৈনিক সংবাদ’অফিসে আগুন দেয়। লেখক ও সাংবাদিক শহিদ সাবের সে রাতে ঐ অফিসেই ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুমন্ত অবস্থায় সংবাদ অফিসে পুড়ে মারা যান তিনি। শহিদ হন সেলিনা পারভীন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে প্রাণ দেন কবি-সাংবাদিক মেহেরুন্নেসা। তারা হত্যা করে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে। তখন তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলেছিলেন। কুমিল্লার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে শত্রুসেনারা তাঁকে হত্যা করে। অধ্যক্ষ যােগেশচন্দ্র ঘােষ, দেশবাসীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আয়ুর্বেদীয় একটি প্রতিষ্ঠান সাধনা ঔষধালয়। ৮৪ বছর বয়স্ক এই মানুষটিও রেহাই পাননি পাকিস্তানি শত্রুদের হাত থেকে। তাঁকেও হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। এ দেশের সাধারণ মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন রণদাপ্রসাদ সাহা। দানশীলতার জন্য লােকে তাকে ডাকত ‘দানবীর’ বলে। হত্যা করা হয় তাকে। চট্টগ্রামের বিখ্যাত সমাজসেবক ছিলেন নূতনচন্দ্র সিংহ। 

শত্রুসেনারা তাঁকেও রেহাই দেয়নি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহিদদের স্মরণ করে আমরা ফুল দিতে যাই শহিদ মিনারে। তখন আমাদের মনে আর মুখে বেজে ওঠে একটি গান- “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। এ গানে সুর দেন আলতাফ মাহমুদ। প্রতিভাবান এই সুরসাধকের প্রাণ কেড়ে নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে তারা বুঝতে পারে যে, তাদের পরাজয় অবধারিত। তখন তারা এদেশকে আরও গভীরভাবে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয়। তারা জানে এদেশের মনবী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ ও সৃষ্টিশীল মানুষদের হত্যা করলে এদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। পাকিস্তানিরা আমাদের সেই অপূরণীয় ক্ষতি করার কাজ শুরু করে। রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সহায়তায় নতুন করে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর। বিভিন্ন আবাসস্থল থেকে তারা ধরে নিয়ে যায় দেশের শক্তিমান, যশস্বী ও প্রতিভাবানদের। তারা ধরে নিয়ে যায় অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও অধ্যাপক আনােয়ার পাশাকে। 

তারা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক। তুলে নিয়ে যায় ইতিহাসের অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ও অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদকে। ইংরেজির অধ্যাপক রাশীদুল হাসানও বাদ পড়েন না। শত্রুরা তুলে নিয়ে যায় প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারকে। সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হােসেন, নিজাম উদ্দীন আহমদ ও আন.ম. গােলাম মােস্তফা, প্রখ্যাত চিকিৎসক ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী, মােহাম্মদ মাের্তজাকেও একইভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আরও বহু জনকে। এঁরা কেউই আর জীবিত ফিরে আসেননি। দেশ স্বাধীন হবার পরে এ সকল বুদ্ধিজীবীর অনেকের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায় মিরপুর ও রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে। আবার অনেকের কোনাে সন্ধানও পাওয়া যায়নি। 

তাঁদের স্মরণে প্রতিবছর ১৪ই ডিসেম্বর আমরা পালন করি ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান ছিলেন তাঁরা। তাঁদের প্রাণদান আমরা কখনাে ব্যর্থ হতে দেব না। আমরা তাদের স্মরণ করব চিরদিন। দেশ ও মাতৃভাষার জন্য ত্যাগের মহান আদর্শ তাঁরা স্থাপন করে গেছেন। আমরা সেই আদর্শ অনুসরণ করে নিজেদের যােগ্য মানুষ রূপে গড়ে তুলব। তবেই তাঁদের ঋণ শােধ করা সম্ভব হবে।

নিচের প্রশ্নগুলাের উত্তর বলি ও লিখি। 
ক. ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা এদেশে কী করেছিল?
খ. রাজাকার আলবদর কারা? তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলি ও লিখি।
গ. কোন শহিদ বুদ্ধিজীবী প্রথম পাকিস্তানি গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি | জানান? তাঁর সম্পর্কে বলি ও লিখি।
ঘ. শহিদ সারে কে ছিলেন? তিনি কীভাবে শহিদ হন? |
ঙ. রণদাপ্রসাদ সাহাকে কেন দানবীর বলা হয়?
চ. দুজন শহিদ সাংবাদিকের নাম বলি ও তারা কোথায় কীভাবে শহিদ হন সে সম্পর্কে লিখি।
ছ, আমরা কেন চিরদিন শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করব?
জ, কোন দিনটিকে ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস' হিসেবে পালন করা হয়? কেন?
ঝ. আমরা কীভাবে শহিদদের ঋণ শােধ করতে পারি? 





Post a Comment

0 Comments