শখের মৃৎশিল্প


গ্রামের নাম আনন্দপুর। মামার বাড়ি। কথায় আছে, মামার বাড়ি রসের হাঁড়ি। আসলেই তাই। পড়া নেই, বাধা নেই, যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াও, যা খুশি খাও। এই তাে মামার বাড়ি। গেল বছর পহেলা বৈশাখের ছুটিতে গিয়েছিলাম আনন্দপুর। সেখানে পহেলা বৈশাখে মেলা বসে। মামা বললেন, তােমাদের মেলা দেখাতে নিয়ে যাব।

আমরা ছিলাম চারজন আমি, মামাতাে বােন বৃষ্টি, সােহানা আর ছােট ভাই তাজিন। মেলা বসে সকালে। আমরা একটু দেরি করেই গেলাম। মামা বেশ মজার মানুষ। কাঁধে ঝােলানাে একটা ব্যাগ। তাতে থাকে ছবি আঁকার জিনিস, থাকে একটা বাশি। পড়েন ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটে। মেলার একটু কাছে পৌঁছতেই শুনতে পেলাম নাগরদোলার কাচর ক্যাচর শব্দ। দেখলাম বাঁশের তৈরি কুলাে, ডালা, ঝুড়ি, চালুন, মাছ ধরার চাই, খালুই। আরও কত কী! বসেছে বাঙি, তরমুজ, মুড়ি-মুড়কি, জিলাপি আর বাতাসার দোকান সারি সারি। আরেকটু এগােতেই দেখতে পেলাম কত রঙের, কত বর্ণের বিচিত্র সব মাটির হাঁড়ি। ফুল, পাতা, মাছের ছবি আঁকা সেসবে। রয়েছে। মাটির ঘােড়া, হাতি, বঁড় আর নানা আকারের মাটির পুতুল। আমার চোখ পড়ল কাজ করা অপূর্ব সুন্দর মাটির হাঁড়ির দিকে। মামাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কিসের হাঁড়ি? 

মামা বললেন, এটা শখের হাঁড়ি। শখ করে পছন্দের জিনিস এই সুন্দর হাঁড়িতে রাখা হয়। তাই এর নাম শখের হাঁড়ি। তাছাড়া শখের যেকোনাে জিনিসই তাে সুন্দর। 

আমরা দুটি শখের হাঁড়ি কিনলাম। অবাক হলাম, পুতুলের পাশেই ঘােলা চোখে চেয়ে আছে এক চকচকে রুপালি ইলিশ। পদ্মার তাজা ইলিশের মতােই। তেমনি সাদা আঁশ, লাল ঠোট। আমরা একটা মাটির ইলিশও কিনলাম। মামা বললেন, ওই যে পুতুলগুলাে দেখছ ওগুলাে টেপা পুতুল। নরম এঁটেল মাটি টিপে টিপে এসব পুতুল বানানাে হয়। যেমন- বউ জামাই, কৃষক, নথপরা ছােট্ট মেয়ে-নানা রকমের মাটির টেপা পুতুল। মেলার এক প্রান্তে বড় জায়গা জুড়ে এসব মাটির পুতুলের দোকান। মামা বললেন, এগুলাে হচ্ছে মাটির শিল্পকলা। মামা বুঝিয়ে বললেন- যখন কোনাে কিছু সুন্দর করে আঁকি বা বানাই অথবা গাই, তখন তা হয় শিল্প। শিল্পের এ কাজকে বলে শিল্পকলা। আমাদের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প হচ্ছে মাটির শিল্প। এ দেশের কুমার সম্প্রদায় যুগ  ধরে তৈরি করে আসছেন মাটির জিনিস। যেমন- কলস, হাঁড়ি, সরা, বাসনকোসন, পেয়ালা, সুরাই, মটকা, জালা, পিঠে তৈরির নানা ছাঁচ। আরও কত কী! মাটির তৈরি শিল্পকর্মকে আমরা বলি মাটির শিল্প বা মৃৎশিল্প। এ শিল্পের প্রধান উপকরণ হলাে মাটি। তবে সব মাটি দিয়ে এ কাজ হয় ।

দরকার পরিষ্কার এঁটেল মাটি। এ ধরনের মাটি বেশ আঠালাে। দোআঁশ মাটি তেমন আঠালাে নয়। আর বেলে মাটি তাে ঝরঝরে – তাই এগুলাে দিয়ে মাটির শিল্প হয় না। এঁটেল মাটি হলেই যে তা দিয়ে শিল্পের কাজ করা যাবে তাও নয়। এজন্য অনেক যত্ন আর শ্রম দরকার। দরকার হাতের নৈপুণ্য ও কারিগরি জ্ঞান। কুমারদের কাছে এসব খুব সহজ। কারণ তারা বংশ পরম্পরায় এ কাজ করে আসছেন। আবার এ কাজের জন্য প্রয়ােজন কিছু ছােটখাটো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম। সবকিছুর আগে যেটা দরকার তা হলাে একটা কাঠের চাকা। এই চাকায় নরম মাটির তাল লাগিয়ে নেন কুমাররা। তারপর চাকাটি জোরে ঘােরান। 

আর হাত দিয়ে মাটির তাল ধরেন। এভাবে নানা আকারের মাটির পাত্র ও নানা জিনিস তৈরি করেন কুমাররা। মেলা থেকে সেদিন আমরা অনেক টেপা পুতুল, ঘােড়া, হাতি, ছােট কলস কিনলাম। মামা বললেন, এত সুন্দর নকশা দেখছ, রং দেখছ- এ সবই গ্রামের শিল্পীদের তৈরি। নকশাগুলাে তারা মন থেকে আঁকেন। আর রং তৈরি করেন শিম, সেগুন পাতার রস, কাঁঠাল গাছের বাকল থেকে। তবে আজকাল বাজার থেকে কেনা রংও লাগানাে হয়। মেলা থেকে কদমা, বাতাসা, মুড়কি ও খৈ কিনে শখের হাঁড়ি ভর্তি করে আমরা ফিরলাম। খুব মজা হলাে।

মামা বললেন, তােমাদের কাল কুমারপাড়ায় নিয়ে যাব। পরদিন আমরা দেখতে গেলাম কুমারপাড়া। আনন্দপুর গ্রামের উত্তর দিকে আট-দশ ঘর বসতবাড়ি। এই নিয়ে কুমারপাড়া। এখানে সবাই ব্যস্ত। কেউ মাটির তাল চাক করে সাজিয়ে রাখছেন। কেউ-বা কাঠের চাকায় মাটি লাগিয়ে নানা আকারের পাত্র বানাচ্ছেন। কেউ-বা এগুলাে সারি সারি করে শুকোতে দিচ্ছেন রােদে। পাশেই। রয়েছে মাটির জিনিস পােড়ানাের চুলা। উঁচু ছােট্ট ঢিবির মতাে এই চুলা। মাটির পােড়া গন্ধ ও 
২০১৯ পাচ্ছি। 

আর ধোঁয়া বেরােচ্ছে। ছােট ছােট ছেলেমেয়েরাও এ কাজ করছে। মামা বললেন, হাঁড়ি কলসি ছাড়াও আমাদের দেশে এক সময় সুন্দর পােড়ামাটির ফলকের কাজ হতাে। এর অন্য নাম টেরাকোটা। বাংলার অনেক পুরানাে শিল্প এই টেরাকোটা। নকশা করা মাটির ফলক ইটের মতাে পুড়িয়ে তৈরি করা হতাে এই টেরাকোটা। শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ও দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরে এই টেরাকোটার কাজ রয়েছে। মাটির ফলকে ছবি এঁকে শুকিয়ে পােড়ানাের পর এগুলাে এমন সুন্দর হয়ে ওঠে! ছােট ছােট ফলককে পাশাপাশি জোড়া দিয়ে বড় করা যায়। পােড়ামাটির এই ফলক বাংলার প্রাচীন মৃৎশিল্প। মামা বললেন, টেরাকোটা বা পােড়ামাটির এসব কাজ এ দেশে শুরু হয়েছে হাজার বছর আগে। 

আজকাল কি পােড়ামাটির এই শিল্পচর্চা হয় না? মামার কাছে জানতে চাইলাম আমরা। মামা বললেন, আজকাল ওরকম টেরাকোটা হচ্ছে না বটে, তবে পােড়ামাটির নকশার কদর বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি ভবনে আজকাল সৌন্দর্য বাড়ানাের জন্য নানা রকম নকশা করা মাটির ফলক ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশের কুমাররা এসব তৈরি করছেন। বললাম, আমরা এসব পােপাড়ামাটির কাজ দেখতে চাই। মামা বললেন, সুযােগমতাে এক সময় তােমাদের শালবন বিহারে নিয়ে যাব।


নিচের প্রশ্নগুলাের উত্তর বলি ও লিখি। 
ক. মাটির শিল্প বলতে কী বুঝি?
খ. বাংলাদেশের প্রাচীন শিল্পকর্ম কোনটি?
গ. শখের হাঁড়ি কী রকম?
ঘ. বৈশাখী মেলায় কী কী পাওয়া যায়?
ঙ. মৃৎশিল্পের প্রধান উপাদান কী?
চ. কয়েকটি মৃৎশিল্পের নাম বলি।
ছ, টেরাকোটা কী?
জ, বাংলাদেশের কোথায় পােড়ামাটির প্রাচীন শিল্প দেখতে পাওয়া যায়?
ঝ, মাটির শিল্প কেন আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবের বিষয়? ঞ. মামার বাড়ি রসের হাঁড়ি- প্রচলিত এই কথাটি দিয়ে কী বােঝানাে হয়?

নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ি এবং প্রশ্নগুলাের উত্তর লিখি। 
যখন কোনাে কিছু সুন্দর করে আঁকি বা বানাই অথবা গাই, তখন তা হয় শিল্প। শিল্পের এ কাজকে বলে শিল্পকলা। আমাদের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প হচ্ছে মাটির শিল্প। এ দেশের কুমার সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে তৈরি করে আসছেন মাটির জিনিস, যেমন-কলস, হাঁড়ি, সরা, বাসনকোসন, পেয়ালা, সুরাই, মটকা, জালা, পিঠে তৈরির নানা উঁচ। আরও কত কী! মাটির তৈরি শিল্পকর্মকে আমরা বলি মাটির শিল্প বা মৃৎশিল্প। এ শিল্পের প্রধান উপকরণ হলাে মাটি। মাটি হলেই যে তা দিয়ে শিল্পের কাজ করা যাবে তাও নয়। এজন্য অনেক যত্ন আর শ্রম দরকার। দরকার হাতের নৈপুণ্য ও কারিগরি জ্ঞান। কুমারদের কাছে এসব খুব সহজ। কারণ তারা বংশ পরম্পরায় এ কাজ করে আসছেন।

ক. শিল্পকলা বলতে কী বােঝ?
খ. শিল্পের কাজের জন্য কী কী প্রয়ােজন?
গ. কেন কুমারদের কাছে এসব কাজ সহজ?

নিচের কথাগুলাে বুঝে নিই।

কান্তজির মন্দির ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজা রামনাথ রায় দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির নির্মাণ করেন। এ মন্দিরের গায়ে স্থাপিত অপূর্ব সুন্দর। টেরাকোটা বাংলার মাটির শিল্পের প্রাচীন নিদর্শন।

পাহাড়পুর নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন সােমপুর বিহার। এই সােমপুর বিহারের আশপাশের বড় বৌদ্ধ মন্দিরে পাওয়া গেছে অনেক সুন্দর টেরাকোটা। এগুলাে অষ্টম শতকের অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় বারাে শ বছর আগের তৈরি।

শালবন বিহার কুমিল্লার ময়নামতিতে মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন। অষ্টম শতকের এই পুরাকীর্তি বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার পরিচায়ক। শালবন বিহারে পাওয়া গেছে নানা ধরনের পােড়ামাটির
ফলক।

মহাস্থানগড় বগুড়া শহর থেকে ১৮ কিলােমিটার উত্তরে করতােয়া নদীর তীরে অবথিত মহাস্থানগড়। যিশু খ্রিষ্টের জন্মের পূর্বে তৃতীয় থেকে পরবর্তী পনেরাে শতকে। বালার এ প্রাচীন নগর গড়ে ওঠে। মহাস্থানগড়ে পাওয়া গেছে অনেক। পােড়ামাটির ফলক,পাত্র, অলংকার ও মূর্তি।

Post a Comment

0 Comments