ষোড়শ শতাব্দীতে লন্ডনের এক বস্তিতে টম ক্যান্টি নামে একটি ছেলের জন্ম হলাে। তার বাবামায়ের মুখে হাসি নেই। কারণ তারা খুব দরিদ্র। তাদের চিন্তা বাড়ল এই ভেবে যে, আরও একটা মুখে খাবার জোটানাের ব্যবস্থা করতে হবে। আর ঠিক একই সময়ে একই দিনে ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ড টিউডরের ঘরে একটি ছেলের জন্ম হুলাে। এই ছেলের জন্যে রাজ্যময় খুশির ঢেউ বই এবং নানা আনন্দ-উৎসবের আয়ােজন হলো।
রাজকুমার বিজ্ঞ পণ্ডিতের কাছে বিদ্যাশিক্ষা নিতে লাগলেন আর বস্তির ছেলে টম বস্তির লােকের কাছ । থেকে ভিক্ষা করার শিক্ষা নিল। তবে সে এক ধর্মযাজক ফাদার এন্ডুর কাছে কিছু কিছু লেখাপড়া শিখছিল। বিশেষ করে ল্যাটিন শিখছিল। টম ছিল কল্পনাবিলাসী, সে সবসময় রাজা আর রাজকুমারদের স্বপ্নে বিভাের হয়ে থাকত। সে যতই রাজকীয় কল্পনাতে ডুবে থাকত ততই সবার উপহাসের পাত্র হতাে। তার সমবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে সে রাজকুমার নামেই পরিচিত হতে চাইত। সেজন্য তাদের নিয়ে রাজকীয় সভার অনুসরণ করে নিজে রাজা হতাে এবং অন্যদের উপাধি বণ্টন করত। ছেলেমেয়েরাও তার এই পাগলামি খেলা উপভােগ করত এবং আনন্দ পেত। সে মনে মনে ভাবত : আহা সত্যিকার রাজকুমারের যদি দেখা পেতাম।
একদিন সে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে এক অচেনা জায়গায় এসে গেল। সেখানে সে বিরাট বিরাট অট্টালিকা দেখল। এই অট্টালিকাগুলাের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ওয়েস্টমিনস্টারস প্যালেসে সে এল। এসে মনে মনে ভাবল, এত বড় অট্টালিকা নিশ্চয়ই কোনাে রাজপ্রাসাদ হবে। এমন সময় গেটের ফাক দিয়ে সে তার বয়সী এক বালককে সুন্দর পােশাক পরা অবস্থায় দেখতে পেল। তখনই সে মনে মনে ভাবল, এ নিশ্চয়ই সত্যিকারের রাজকুমার হবে। ঠিক এমনি সময় পিছন থেকে তার ঘাড়ে এক পদাঘাত এল। বতুত এই পদাঘাতটি ছিল দারােয়ানের। সে বলল, এই ভিখারির বাচ্চা, সরে পড়। কোন সাহসে এখানে এসেছিস? অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে গেটের ভিতরের রাজকুমারের নজরে সমস্ত ব্যাপারটা পড়ে গেল। রাজকুমার চিৎকার করে বলে উঠলেন দারােয়ান, আমার বাবার গরিব প্রজার সঙ্গে এমন জঘন্য ব্যবহার করতে তুমি কী করে সাহস পেলে? এখনই দরজা খুলে এই বালককে আমার কাছে নিয়ে এসাে।
ভিতরে ঢােকার পর রাজকুমার বললেন, তুমি পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত এবং তােমার প্রতি খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। তুমি আমার সঙ্গে এসাে।
কথাটা যেন টমের বিশ্বাস হতে চায় না। সে বলল, ঠিক বলছেন তাে স্যার, আপনার সঙ্গে আসব?
রাজকুমার অভয় দিয়ে বললেন, হ্যা তােমার কোনাে ক্ষতি হবে না। তুমি আমার সঙ্গে এসাে।
টম রাজকুমারের সাথে ভিতরে গেল। দুজনে অনেক গল্প হলাে। রাজকুমার টমকে রাজপ্রাসাদ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন। টমের কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতাে মনে হতে লাগল। সে রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে কি সবসময় এই সুন্দর পােশাক পরে থাকতে হয়?
রাজকুমার বিজ্ঞ পণ্ডিতের কাছে বিদ্যাশিক্ষা নিতে লাগলেন আর বস্তির ছেলে টম বস্তির লােকের কাছ । থেকে ভিক্ষা করার শিক্ষা নিল। তবে সে এক ধর্মযাজক ফাদার এন্ডুর কাছে কিছু কিছু লেখাপড়া শিখছিল। বিশেষ করে ল্যাটিন শিখছিল। টম ছিল কল্পনাবিলাসী, সে সবসময় রাজা আর রাজকুমারদের স্বপ্নে বিভাের হয়ে থাকত। সে যতই রাজকীয় কল্পনাতে ডুবে থাকত ততই সবার উপহাসের পাত্র হতাে। তার সমবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে সে রাজকুমার নামেই পরিচিত হতে চাইত। সেজন্য তাদের নিয়ে রাজকীয় সভার অনুসরণ করে নিজে রাজা হতাে এবং অন্যদের উপাধি বণ্টন করত। ছেলেমেয়েরাও তার এই পাগলামি খেলা উপভােগ করত এবং আনন্দ পেত। সে মনে মনে ভাবত : আহা সত্যিকার রাজকুমারের যদি দেখা পেতাম।
একদিন সে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে এক অচেনা জায়গায় এসে গেল। সেখানে সে বিরাট বিরাট অট্টালিকা দেখল। এই অট্টালিকাগুলাের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ওয়েস্টমিনস্টারস প্যালেসে সে এল। এসে মনে মনে ভাবল, এত বড় অট্টালিকা নিশ্চয়ই কোনাে রাজপ্রাসাদ হবে। এমন সময় গেটের ফাক দিয়ে সে তার বয়সী এক বালককে সুন্দর পােশাক পরা অবস্থায় দেখতে পেল। তখনই সে মনে মনে ভাবল, এ নিশ্চয়ই সত্যিকারের রাজকুমার হবে। ঠিক এমনি সময় পিছন থেকে তার ঘাড়ে এক পদাঘাত এল। বতুত এই পদাঘাতটি ছিল দারােয়ানের। সে বলল, এই ভিখারির বাচ্চা, সরে পড়। কোন সাহসে এখানে এসেছিস? অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে গেটের ভিতরের রাজকুমারের নজরে সমস্ত ব্যাপারটা পড়ে গেল। রাজকুমার চিৎকার করে বলে উঠলেন দারােয়ান, আমার বাবার গরিব প্রজার সঙ্গে এমন জঘন্য ব্যবহার করতে তুমি কী করে সাহস পেলে? এখনই দরজা খুলে এই বালককে আমার কাছে নিয়ে এসাে।
ভিতরে ঢােকার পর রাজকুমার বললেন, তুমি পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত এবং তােমার প্রতি খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। তুমি আমার সঙ্গে এসাে।
কথাটা যেন টমের বিশ্বাস হতে চায় না। সে বলল, ঠিক বলছেন তাে স্যার, আপনার সঙ্গে আসব?
রাজকুমার অভয় দিয়ে বললেন, হ্যা তােমার কোনাে ক্ষতি হবে না। তুমি আমার সঙ্গে এসাে।
টম রাজকুমারের সাথে ভিতরে গেল। দুজনে অনেক গল্প হলাে। রাজকুমার টমকে রাজপ্রাসাদ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন। টমের কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতাে মনে হতে লাগল। সে রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে কি সবসময় এই সুন্দর পােশাক পরে থাকতে হয়?
নিশ্চয়ই।
আপনার জীবন কি সুখের!
আর রাজকুমার শুনল টমের বস্তি জীবনের কথা।
সে বলল, যেকোনাে সময় নদীতে সাঁতার কাটা যায়, কাদা নিয়ে খেলা করা যায়, একে অন্যের দিকে কাদা ছুড়ে মেরে মজা করা যায়।
তখন রাজকুমার বললেন, তােমার জীবনও নিশ্চয়ই আনন্দ আর খুশিতে ভরা। আহা! আমি যদি তােমার পােশাক পরে কাদায় খেলা করতে পারতাম, তাহলে কী আনন্দটাই না পেতাম!
টম বলল, আর আমি যদি আপনার পােশাক পরতে পারতাম, তাহলে কী আনন্দই না পেতাম!
রাজকুমার বললেন, তুমি যদি চাও তাহলে আমরা পােশাক বদল করতে পারি।
তারপর তারা উভয়ে পােশাক বদল করে নিল। তারা উভয়ে একে অপরের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল, কারণ তাদের চেহারা ও পােশাকে কে যে ভিখারির ছেলে আর কে যে রাজকুমার তা কেউ চিনে বের করতে পারবে না। কারণ তাদের দুজনের চেহারা দেখতে হুবহু এক।
শুধু পােশাক দ্বারা তাদের ভিন্ন করা যায়। টমের হাতের আঘাত পরীক্ষা করে রাজকুমার বললেন, উহ! তােমার নিশ্চয়ই খুব লেগেছিল? টম বলল, না, ও কিছু নয়। আমি এমনি আঘাত আর মার খেয়ে অভ্যমত! যে দারােয়ান টমকে মেরেছিল তাকে শাসিত দেওয়ার জন্য ভিক্ষুকের পােশাকে রাজকুমার বাড়ির ৪ গেটের দিকে গেলেন ও চিৎকার করে বললেন, দরজা খােলাে। দারােয়ান তার কথামতাে দরজা খুলে দিল।
রাজকুমার যেইমাত্র দরজার বাইরে বেরিয়েছেন অমনি দারােয়ান তাকে কষে এক চড় দিয়ে বলল, হে ভিখারির ছেলে, আমাকে রাজকুমারের হাতে বকা খাওয়ানাের জন্য এটা তাের বখশিশ। ভিখারির পােশাকে রাজকুমার মাটিতে পড়া অবস্থায় বললেন, বদমাইশ, আমি হচ্ছি রাজকুমার এডওয়ার্ড আর রাজকুমারের গায়ে হাত তােলা মত অপরাধ। তখন দারােয়ান বলল, দূর হ ভিখারি, এখান থেকে। এই সময় রাস্তার লােকজনও তাকে মারল।
তাদের হাত থেকে অনেক কষ্টে বের হয়ে রাজকুমার একা একা পথ চলতে লাগলেন। চলতে চলতে এক সময় তিনি এক অচেনা পথে চলে এলেন। এখানে তিনি একটা ছােট ছেলেমেয়েদের হােস্টেল দেখলেন। তখন তাঁর মনে হলাে যে, এই হােস্টেল নির্মাণ করেছেন তার বাবা। তাই তিনি সাহস করে হােস্টেলের ভিতর ঢুকে বললেন, হে কিশােররা, আমি তােমাদের সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। তােমরা ভিতরে গিয়ে বসাে ও অন্যদের বলাে যে, রাজকুমার এডওয়ার্ড তাদের সঙ্গে আলাপ করতে চান।
সেখানকার ছেলেমেয়েরা বেশ মজা পেল। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, ছেলেটা নিশ্চয়ই পাগল হবে। ঠিক আছে, আমরা সবাই তাকে রাজকুমার মনে করে সম্মান দেখাই। দেখা যাক ব্যাপারটা কতদূর গড়ায়। তাই সবাই হাঁটু গেড়ে বসে রাজকুমারকে সম্মান দেখাল। তারপর সবাই তাকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে সামনের পুকুরে ছুড়ে ফেলল। রাজকুমার আবার সবার হাতে অপমানিত হলেন।
পুকুর থেকে উঠে তিনি আবার হাঁটতে লাগলেন। দিন শেষে রাত্রি ঘনিয়ে এল। তখন রাজকুমার ভাবলেন : আমার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। আমার একমাত্র উপায় হলাে টমের বাড়ি খুঁজে বের করা। তাহলে তার পিতা-মাতা আমার প্রাসাদের দারােয়ানের কাছে গিয়ে বললেই হয়তাে আমার এই বিপদ কেটে যাবে।
তারপর তিনি নিকটস্থ বস্তি এলাকায় ঘােরাঘুরি করতে লাগলেন। এমন সময় হঠাৎ একটা বলিষ্ঠ হাত তার হাত ধরল। তিনি চিৎকার করে উঠলেন,বাঁচাও বাঁচাও! সেই হাতের অধিকারী তখন বললেন, এই বদমাইশ, চিৎকার করছিস কেন? এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তাের হাড়গুলি সব পিটিয়ে ভাঙব না হলে আমার নাম জন ক্যান্টিই নয়। রাজকুমার তখন তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ইশ, কী সৌভাগ্য আমার! তাহলে তুমিই তার বাবা? লােকটা বললেন, কী বলিসরে ছােকরা? আমি তার বাবা নই, আমি তাের বাবা। রাজকুমার বললেন, মহাশয় আমার সঙ্গে দয়া করে তামাশা করবেন না। আমি বড় বিপদে পড়েছি। দয়া করে আমার প্রাসাদের দারােয়ানকে যদি আপনি বলে দেন যে, আমি আপনার ছেলে নই, আমি রাজকুমার প্রিন্স অব ওয়েলস।
এ-কথা শােনার পর লােকটা বললেন, প্রিন্স অব ওয়েলস, পাগল, তােকে বেত দিয়ে পিটিয়ে ঠিক করতে হবে। তাহলেই তাের পাগলামি ছুটবে। তারপর টমের বাবা তাকে খুব মারতে লাগলেন। আর রাজকুমার চিৎকার করতে লাগলেন, আমাকে যেতে দাও, আমি তােমার ছেলে নই। আমি রাজকুমার প্রিন্স অব ওয়েলস। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে ফাদার এন্ড্রুকে দেখা গেল। তিনি এসে বলনে, থামাে ছেলেকে মেরাে না, সে অসুস্থ। সে তাে তােমার কোনাে ক্ষতি করছে না। জন ক্যান্টি তখন রাগের মাথায় ফাদারকে এক ঘা বসিয়ে দিলেন ও রাজকুমারকে বাড়ির উপরতলায় পাঠিয়ে দিলেন। তার কিছুক্ষণ পর তিনি বাড়ির উপরতলায় এসে রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করলেন, বল তাের নাম কী? রাজকুমার উত্তর দিলেন, আমি তাে ভােমায় আগেই বলেছি যে আমার নাম। এডওয়ার্ড প্রিন্স অব ওয়েলস। টমের মা তখন আফসােস করে বলে উঠলেন, টম তুমি যে বই নিয়ে পড়াশােনা করেছ,তাতেই এটা হয়েছে। রাজকুমার বললেন, আমি আপনাকে দুঃখ দেওয়ার জন্য দুঃখিত। তবে আমি জীবনে আপনাকে আর কখনাে দেখিনি। এ-কথা শুনেই টমের বাবা বেত দিয়ে রাজকুমারকে খুব মারলেন। রাজকুমার তার রাজকীয় কায়দায় যতই বড় বড় কথা বলেন তার বাবা ততই তাকে মারেন। অবশেষে টমের বাবা ক্লান্ত হয়ে রাজকুমারকে ছেড়ে দিয়ে গেলেন।
ক্লান্ত রাজকুমার খড়ের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লেন। টমের মা লক্ষ করলেন যে টম তার হাত মাথার উপর রেখে ঘুমায়নি। মাথার উপর হাত রেখে ঘুমানােটা টমের অনেক দিনের অভ্যাস। তাই তিনি রাজকুমারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলেন। কিন্তু রাজকুমার তার হাত মাথায় নিয়ে গেলেন না। এমনিভাবে রাতে তিনি তিনবার এ-কাজটি করলেন। তবু তিনি স্থির করতে পারলেন না! টমের মায়ের মনে যে সন্দেহ হয়েছিল তা তিনি জোর করে তাড়িয়ে দিলেন। তিনি ভাবলেন, মাথায় গােলমাল হবার জন্য বােধ হয় তার পুরােনাে অভ্যাসটা বদলে গেছে। এদিকে বেশ গভীর রাতে খবর এল যে ফাদার এন্দ্রকে টমের বাবা যে আঘাত করেছিল তার ফলে তিনি মরতে বসেছেন। টমের বাবা ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ পালানাের কথা স্থির করে ফেললেন। তিনি তাড়াতাড়ি তার স্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন- আমি আর টম এখনই চলে যাচ্ছি। তুমি এসে লন্ডন ব্রিজের কাছে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবে। তারপর রাজকুমারকে নিয়ে জন ক্যান্টি পথে বেরিয়ে দেখতে পেলেন এক বিরাট উৎসব মিছিল। পথে উৎসবরত লােকেরা তাকে পান করার জন্য পানীয় দিল। জন ক্যান্টি রাজকুমারকে ছেড়ে যেইমাত্র হাত উপরে তুললেন, এই সুযােগে রাজকুমার ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন। তারপর রাজকুমার খোজ নিয়ে জানতে পারলেন যে রাজকুমারের অভিষেক উপলক্ষে এই উৎসব হয়েছে। তখন তিনি ভাবতে লাগলেন: টম ক্যান্টি কি তাকে ফাঁকি দিল? কিন্তু মনে মনে তিনি বললেন : যেভাবেই হােক আমি তার সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করব।
এদিকে রাজপ্রাসাদে টম ক্যান্টির অবস্থাও বড়ই করুণ। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বলছে বাহ্! আমাকে সত্যি একজন রাজকুমারের মতাে দেখা যাচ্ছে। আহ! আমার বক্তির সবাই যদি আমাকে অন্তত একবার এই পােশাকে দেখতে পেত। কিন্তু যতই সময় অতিবাহিত হতে লাগল, সে ভীত হয়ে পড়তে লাগল। হঠাৎ করে দরজা খুলে একটা মেয়ে এসে তার সামনে দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল- রাজকুমার আপনার কি কোনাে কিছুর প্রয়ােজন আছে? কিন্তু রাজকুমাররুপী টম ক্যান্টি তখন বিড়বিড় করে বলে যাচেচ্ছ, আমি হারিয়ে গেছি-আমি হারিয়ে গেছি। এরা এবার নিশ্চয়ই আমাকে হত্যা করবে। তারপর সে সেই মেয়েটির কাছেই হাঁটু গেড়ে বসে বলতে লাগল, আমাকে দয়া করাে, আমি রাজকুমার নই, আমি টম ক্যান্টি। আমার ছেড়া কাপড়চোপড় আমাকে ফিরিয়ে দাও এবং আমায় বাড়ি যেতে দাও। কিন্তু মেয়েটি কোনাে কথা না বলে দৌড়ে পালিয়ে গেল। তারপর এখান থেকে সেখানে এমনিভাবে প্রচার হয়ে গেল যে রাজকুমার পাগল হয়ে গেছে। সে অপ্রকৃতিস্থ এবং রাজা নিজে একটা ফরমান জারি করে সবাইকে সাবধান করে দিলেন যে রাজকুমারের অসুখের কথা যেন রাজপ্রাসাদের বাইরে না যায়।
একদিন রাজকুমাররুপী টমকে রাজার কাছে নিয়ে যাওয়া হলাে। সেখানে রাজাকে দেখে টম বলে উঠল, আপনিই হলেন এখানকার রাজা? এই কথা শুনে রাজা বললেন, আমি যে গুজব শুনেছিলাম তা দেখছি সত্যি। রাজা আদর করে তাকে ডাকলেন। কিন্তু টম বলে উঠল, মহাশয়, আপনি আমার বাবা নন এবং আমিও রাজকুমার নই। আমি আপনার অধীন একজন গরিব প্রজা। কোনাে এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে আমি এখানে এসে পড়েছি। আমি আপনার কোনাে ক্ষতি করিনি। আমাকে হত্যা করবেন না।
রাজা ভাবলেন, বােধ হয় সে তার নিজের পরিচয় ভুলে গেছে। তাই পরীক্ষা করার জন্য ল্যাটিন ভাষায় প্রশ্ন করলেন। টম ঠিক ঠিক উত্তরই দিল। তখন রাজা মনে মনে ভাবলেন যে বেশি পড়াশােনা করার জন্য তার এই অবস্থা হয়েছে। তাকে খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখতে হবে। সে হলাে আমার একমাত্র উত্তরাধিকারী। আর কালই তার অভিষেক করতে হবে। রাজা যাকে কথাগুলাে বলছিলেন তিনি বলে উঠলেন, হুজুর আপনি কি ভুলে গেছেন নরফোকের ডিউক এখনও আপনার রাজনৈতিক বন্দি, ভাকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন। রাজা বললেন, সে আদেশ ঠিক থাকবে। ঠিক আছে হুজুর, বলে লােকটা বিদায় নিল।
সেদিন রাজকুমারের ঘরে বসে টম একা একা বিরক্ত হয়ে উঠল নিজের উপর। সে বলল, উহ্। এটা অসহ্য, রাজার আদেশে ঐ লােকটাকে হত্যা করা হবে। আহা! এই সময় যদি সত্যিকারের রাজকুমার ফিরে আসতেন।
সেদিন বিকেলে লর্ড হাটফোর্ড রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করে বললেন, তুমি যেই হও, তুমি যে রাজকুমার নও এ-কথা অস্বীকার করবে না ! টমও ভাবল, ঠিক আছে তারা যেভাবে বঙ্গে সেভাবে চলে দেখি। এরপর থেকে টম রাজকুমারের যাবতীয় কাজ করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু সে পদে পদে ভুল করতে লাগল। যেমন ভালাে তােয়ালে নষ্ট হবে মনে করে হাত মুছতে ভয় পেতে লাগল। গােলাপজল দেওয়া হাত ধােয়ার পানি সে পান করে ফেলল। ফলমূল, বাদাম সব পকেটে পুরে ফেলতে লাগল। সেদিন আরও অবনতি হলাে।
রাজার সঙ্গে রাজার পরামর্শদাতা লর্ড চ্যান্সেলর দেখা করলেন। রাজা বললেন, আমি শীঘ্রই মারা যাব। ডিউক অব নরফোকের মৃত্যুর পরােয়ানা জারি করতে হবে। তাই একটা মৃত্যুর পরােয়ানা লিখে নিয়ে এসাে, আমি তাতে আমার সিল দিয়ে দিই। রাজা বিছানায় উঠে বসতে চাইলেন কিন্তু দুর্বলতার জন্য পারলেন না। এদিকে বড় সিলটা অনেক খোঁজার পরও পাওয়া গেল না। রাজা মনে মনে বললেন, আমি রাজকুমারের কাছে সিলটা রেখেছিলাম। রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করা হলাে, সে বলল যে, সে সিলটা কোথায় রেখেছে তা মনে করতে পারছে না। আপাতত ছােট সিল দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে। রাজকুমারকে আনন্দিত রাখার জন্য তাকে নৌবিহারে নিয়ে যাওয়া হলাে। কিন্তু এতসব আনন্দের মধ্যে থেকেও সে সুখী হতে পারছিল না।
এদিকে সত্যিকারের রাজকুমার রাস্তায় রাস্তায় লাঞ্ছিত হচ্ছিলেন। রাজকুমারকে এই লাঞ্ছনার হাত থেকে বঁচানাের জন্য একজন জোয়ান এগিয়ে এসে সবাইকে বাধা দিলেন। ফলে সৈনিকের সঙ্গে বিদ্রুপকারীদের তর্ক শুরু হলাে। আর ঠিক এই সময় রাজার ঘােড়সওয়ারেরা সেই রাস্তায় তাদের মাঝখানে এসে পড়ল এবং সৈনিক ও রাজকুমার সবার থেকে আলাদা হয়ে পালিয়ে গেলেন।
এর কিছুক্ষণ পর রাস্তায় রাস্তায় এক ফরমান পাঠ করা হলাে। এতে সবাইকে বলা হলাে যে, রাজা মারা গিয়েছেন এবং রাজকুমার এডওয়ার্ড নতুন রাজা হয়েছেন। টম তার উপদেষ্টা লর্ড হাটফোর্ডকে জিজ্ঞাসা করল, আমি যদি এখন থেকে রাজা হয়ে থাকি তাহলে আমার আদেশ বহাল থাকবে? লর্ড হাটফোর্ড বললেন, নিশ্চয়ই আপনার হুকুমই আইন। টম ক্যান্টি তখন বলল : আমার রাজত্ব হবে দয়ার, ক্ষমার। কোনাে রক্তপাত হবে না আমার রাজত্বে এবং নােরফোকের ডিউকের মৃত্যুদণ্ড আমি তুলে নিয়ে তাকে মুক্ত করলাম।
অন্যদিকে রাজকুমার যখন তার নতুন বন্ধুকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিলেন তখন রাজার মৃত্যুসংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, আমার বাবা মারা গিয়েছেন। নতুন সৈনিকটি বলল, ওহহা আমি তাে ভুলেই গিয়েছিলাম যে তুমি রাজকুমার এডওয়ার্ড, এ দেশের নতুন রাজা। সৈনিক মনে মনে ভাবছিল : আহা বেচারা, তার মাথাটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমি সব অবস্থাতে এই ছেলেটিকে আপদে-বিপদে রক্ষা করে যাব।
এরপর সৈনিকটি রাজকুমারকে একটা সরাইখানাতে নিয়ে গেলেন। কিন্তু যেইমাত্র তারা সেখানে ঢুকতে যাবেন তখনই টমের বাবার সঙ্গে দেখা। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, এবার তুই পালিয়ে যেতে পারবি না বাছাধন, তােকে আচ্ছা করে পিটুনি দেব। সৈনিক লােকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটি তােমার কী হয়? লােকটি উত্তর দিলেন, এই বজ্জাত ছেলেটি আমার ছেলে। রাজকুমার বলে উঠলেন, মিথ্যা কথা, আমাকে যেন এই লােকটার জিম্মায় ছেড়ে দিও না। সৈনিক বললেন, আমি তােমাকে বিশ্বাস করি। তুমি আমার সাথেই থাকবে। জন ক্যান্টি তখন গজরাতে গজরাতে বললেন, আচ্ছা দেখা যাবে। সৈনিক তখন তার খাপ থেকে তলােয়ার বের করে বললেন, সাবধান একে ছুঁয়েছ কি তােমার একদিন কি আমার একদিন। এই ছেলে আমার তত্ত্বাবধানে থাকবে। তুমি কি মনে করাে তােমার মতাে একজ্জল জঘন্য ব্যক্তির হাতে একে ছেড়ে দেব? যাও এখান থেকে সরে পড়াে, আর এ ব্যাপারে চুপচাপ থাকতেই চেষ্টা করাে।
সৈনিক রাজকুমারকে বললেন, আমি থাকতে তােমার কোনাে অসুবিধা হবে না বা কেউ জ্বালাতনও করতে পারবে না। রাজকুমার বললেন, সৈনিক, তােমাকে ধন্যবাদ, আমি যখন আমার সিংহাসনে আরােহণ করব তখন তােমার কথা আমার মনে থাকবে। তারপরে সরাইখানাতে গিয়ে রাজকুমার ঘুমালেন আর সৈনিক তার জন্য একটা পােশাকের ব্যবস্থা করার জন্য চলে গেলেন।
ভােরে সৈনিক নিজ হাতে একটা পােশাক কিনে নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখেন রাজকুমার বিছানায় নেই। তখন তিনি দৌড়ে সরাইখানাওয়ালার কাছে গিয়ে হুমকি দিলেন। তখন সরাইখানাওয়ালা বললেন, ও তাে আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। আপনার সংবাদবাহক এসে খবর দিয়েছে যে আপনি তাকে লন্ডন ব্রিজের ওখানে দেখা করতে বলেছেন।
সাদবাহক কি একা ছিল?
হ্যা, কিন্তু সে যখন ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেল,তখন আরও একজন বদমাইশ প্রকৃতির লােক তাকে অনুসরণ করছিল।
একথা শুনে সৈনিক ছুটলেন রাজকুমারের খোঁজে।
এদিকে নকল রাজকুমার টম বিচার ও অন্যান্য রাজকার্য সমাধা করে যাচ্ছে। আর সত্যিকার রাজকুমার লন্ডন ব্রিজের দিকে তার রাজপ্রাসাদের কারও সঙ্গে দেখা হবে এই আশায় সেদিকে চলেছেন। হঠাৎ রাজকুমারের কানে এল, তােমার রক্ষক বন্ধু তােমাকে আজ রক্ষা করার জন্য আসছে না। রাজকুমার বললেন, এটা কোন ধরনের ধূর্ততা। তখন জন ক্যান্টি চাবুক হাতে এগিয়ে এসে বললেন,
নিশ্চয়ই তুই তাের বাবাকে চিনতে ভুল করিস নি। এখন এই গুদামঘরের ভিতর ঢােক এবং যতদিন পর্যন্ত আমার জন্য ভিক্ষা করতে রাজি না হবি । এখানেই তােকে কাটাতে হবে। এদিকে সেই সৈনিক পইপই করে রাজকুমারকে খুঁজছেন। পরে তিনি অনুমান করলেন যে সেই বদমাইশ লােকটা যে তাকে ছেলেটির বাবা বলে পরিচয় দিতে চেষ্টা করেছিল, নিশ্চয়ই সে তাকে কোথাও আটকে রেখেছে। ভীত ও সন্ত্রস্ত রাজকুমার পুরাতন গুদামের মধ্যে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
হঠাৎ রাতে যখন তার ঘুম ভাঙল তখন তিনি দেখলেন যে কয়েকজন চোরের এক সভা বসেছে। তারা সবাই চুরির জন্য নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবনে ব্যত। রাজকুমারের দিকে চোখ পড়তেই তাকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে তার মাথায় এক হেঁড়া টুপি পরিয়ে দলের নেতা বললেন, আমি তােমাকে ফুফু দি ফাস্ট নামে নামকরণ করলাম। পরের দিন ভােরে রাজকুমার ও তার সঙ্গী ছেলেটি ভিক্ষা করতে বের হলেন। রাজকুমারকে ছেলেটি বলল, তুমি আমাকে হাগস বলে ডাকতে পারাে। রাজকুমার বললেন, কিন্তু আমি তােমার মতাে ভিক্ষা করতে পারব না। হাগস বলল, তুমি এত সাধু হলে কবে থেকে? তােমার বাবা যে বলল, তুমি গত জীবনে লন্ডনে ভিক্ষা করে কাটিয়েছ? রাজকুমার বললেন, ওই বদমাইশটা আমার বাবা নয়। এমন সময় হাগস বলল, শীঘ্র এদিকে এসাে।
একজন ধনী লােক এদিকে আসছে। তােমাকে ভিক্ষা করতে হবে না। তুমি শুধু ভান করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর আমি মাটির উপর শুয়ে অজ্ঞান হবার ভান করব। যখন ধনী লােকটি তােমার সামনের দিকে আসবে তখন হইচই করে চিৎকার করে বলবে যে আমি তােমার ভাই এবং আমরা কয়েক দিন কিছুই খাইনি। তারপর ছেলেটি রাজকুমারকে শাসিয়ে বলল, ঠিকমতাে যদি কথা না শােনাে তাহলে তােমার শরীরের হাড়গুলাে ভেঙে গুঁড়াে গুঁড়াে করব। ধনী ভদ্রলােকটি হাগৃসের কাছে এসে তাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, তােমার কী হয়েছে? তখন সে বলল, আমি এক গরিব ছেলে, অনাহারে ভুগছি, আমাকে দয়া করে একটা পয়সা দিয়ে সাহায্য করুন। লােকটি বললেন, আহা গরিব বেচারা, তােমায় একটা কেন তিনটা পয়সা দিয়ে সাহায্য করব। ছেলেটি বলল, জনাব দয়া করে যদি আমাকে একটু ধরে ধরে আমার বাড়ি পৌঁছে দেন। এমনি সময় রাজকুমার চিৎকার করে উঠলেন, ও আমার ভাই নয়, সে একজন ভিক্ষুক ও চোর, আপনি লক্ষ করলে দেখতে পাবেন যে, সে আপনার পকেট কেটেছে। আপনার লাঠির এক বাড়িতে ওর সব ভান পালাবে। একথা শােনার সঙ্গে সঙ্গে হাস দৌড়ে পালাল।
রাজকুমার সুযােগ খুঁজছিলেন। তিনি ভাবলেন এখন যদি আমি না পালিয়ে যাই তাহলে হাগস ভিক্ষুকদের নিয়ে এসে আমায় তাড়া করবে। তিনি সমস্তটা দিন কৃষকদের জমির চারদিক দিয়ে ঘুরে বেড়ালেন। সন্ধ্যার দিকে এক বনের ধারে এসে হাজির হলেন। এখানে দূরে একটা কুটিরে আলাে জ্বলতে দেখে সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। এই কুটিরটা ছিল একজন ঋষিতুল্য সন্ন্যাসীর। রাজকুমার ভিতরে গিয়ে পরিচয় দিলেন যে, সে ইংল্যান্ডের রাজা। কুটিরের ভিতরের সন্ন্যাসী বললেন, এসাে ভিতরে এসাে। আমার এখানে কাউকে জায়গা দিই না,তবে রাজার জন্য নিশ্চয়ই আমার জায়গা আছে। রাজকুমারকে সম্বােধন করে সন্ন্যাসী বললেন, আমার তােমাকে বিচার করার কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন আমি তােমাকে একটি গােপন তথ্য বলব, আমি সন্ন্যাসী নই। আমি হলাম একজন ফেরেস্তা। তুমি তাহলে হেনরির ছেলে, সে কি বেঁচে আছে? রাজকুমার বললেন, না কিছুক্ষণ আগে তার মৃত্যু হয়েছে।
সন্ন্যাসী তাকে খাইয়ে-দাইয়ে বিছানায় ঘুমােত দিয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে সন্ন্যাসী এসে তাকে বলতে লাগলেন, তুমি তাে জানাে না তােমার বাবা আমার উপর অত্যাচার করেছেন। আমাকে ধর্ম থেকে বিতাড়িত করেছেন। আমাকে ও আমার অনুসারীদের দেশ থেকে তাড়িয়েছেন। এই জঙ্গলে আমি পালিয়ে আছি। যখন বুঝতে পারল যে রাজকুমার ঘুমিয়ে তখন তিনি বললেন , যতক্ষণ বেঁচে আছ সুখস্বপ্ন দেখে নাও। এই বলে তিনি বড় পাথরে ছুরি শান দিতে দিতে বলতে লাগলেন, তােমার বাবা আমার হাত থেকে বেঁচে গেছে, তুমি বাঁচবে না।
তারপর তিনি তার হাত-পা ও মুখ দড়ি ও কাপড় দিয়ে বাঁধলেন। তারপর সন্ন্যাসী যেইমাত্র ছুরি উঁচিয়ে রাজকুমারকে হত্যা করতে যাবেন, ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় কে যেন কড়া নেড়ে জিজ্ঞাসা করল, বাসায় কে আছে? রাজকুমার সেই বর শুনে ভাবলেন, এ তাে সেই সৈনিক কঙ্কুর গলা। সন্ন্যাসী দরজা খুলে দিতেই সৈনিক জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলেটি কোথায়? সন্ন্যাসী বললেন, কোন ছেলে?
তখন সৈনিক রেগে গিয়ে বললেন, যে ছেলেটা চুরি করেছিল তাকে আমি শান্তি দিয়েছি। এখন তােমার এখানে যে এসেছে সে ছেলেটি কোথায়? সন্ন্যাসী প্রথমে নানা কথা বলে তাকে ফঁকি দিতে চাইলেন। কিন্তু সৈনিকের চাপের মুখে সন্ন্যাসী রাজকুমারকে সৈনিকের হাতে তুলে দিলেন। সৈনিক তখন সেই কেনা পােশাক রাজকুমারকে পরিয়ে গ্রাম থেকে দুটি গাধা কিনে এনে তাতে চড়ে শহরের দিকে রওনা হলেন। শহরে হেডেন হলে এসে তারা পৌঁছলেন। এই হেডেন হলটা ছিল সৈনিকের বাড়ি। সৈনিক বাড়ির কড়া নাড়তেই তার ভাই বেরিয়ে এলেন। সৈনিক তখন বললেন, আরে আমার ভাই। উত্। প্রায় সাত বছর পরে তােমার সঙ্গে দেখা। কিন্তু তার ভাই তাকে না চেনার ভান করে বললেন, আপনি কে? সৈনিক বলল, আমি তােমার ভাই মাইস হেডেন। তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না? তখন তার ভাই বললেন,আমার ভাই! তিনি তাে কবে প্রায় তিন বছর হলাে যুদ্ধে মারা গেছেন।
তুমি একজন জালিয়াত। সৈনিক বললেন, তুমি মিথ্যা বলছ। ঠিক আছে, তােমার বাবাকে ডাকো। বাবা মারা গেছেন। উহ্! বড় দুঃখের সংবাদ, তাহলে লেডি এডিথকে ডাকো। কিছুক্ষণ পরে সৈনিকের ভাই এক সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে হাজির হলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, বলাে তাে এই লােকটাকে তুমি চেনাে কি না? লেডি এডিথ বললেন, এ লােকটাকে জীবনে আমি কখনাে দেখিনি। সৈনিক রেগে গিয়ে চিৎকার করে বললেন, বদমাইশ, মিথুক, তুমি নিজে চিঠি লিখে জানিয়েছ যে আমি মরে গেছি এবং তারপর আমার বাগদত্তাকে বিয়ে করেছ। আমার সামনে থেকে দূর হও, নচেৎ তােমায় আমি হত্যা করব। এই বলে সৈনিক তার ভাইকে আক্রমণ করলেন।
আক্রান্ত ভাইয়ের চিৎকারে সব চাকর এসে হাজির। তখন সৈনিকের ভাই হিউগ বললেন, সব দরজা বন্ধ করে দাও যেন এই জালিয়াত পালাতে না পারে। সৈনিক বললেন, আমি পালাচ্ছি না, যে পর্যন্ত আমি ন্যায়মতাে হেনডন হলের উত্তরাধিকারী হচ্ছি। রাজকুমার বললেন, সত্যি বড়ই আশ্চর্যের বিষয়। সৈনিক বললেন, হিউগ ছােটবেলা থেকেই বদমাইশ আর জোচ্চোর স্বভাবের ছিল। রাজকুমার বললেন, আমি ভাবছি যে আমাকে খোঁজার জন্য এখনও কোনাে সৈন্য পাঠানাে হলাে না কেন? সৈনিক মনে মনে বললেন, আহা! বেচারার রাজকীয় দুঃস্বপ্ন এখনও যায়নি। রাজকুমার বললেন, আমি আমার সমস্ত ঘটনা এ কারণে লিখে রেখেছি! এটা তুমি আগামীকাল আমার ও চাচা লর্ড হাটফোর্ডের কাছে পৌঁছে দেবে। সৈনিক বললেন, ঠিক আছে।
ঠিক এমনই সময় একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এল : দয়া করে একটু থামুন স্যার। সৈনিক বললেন, বাগদত্তা বধু এডিথ, তুমি এখনও আমাকে না-চেনার ভান করছ? এডিথ বললেন, আমি দুঃখিত স্যার, না, আমি না-চেনার ভান করছি না। আমি আপনার জন্য সমবেদনা অনুভব করছি। কারণ আপনি মাইলসের মতাে দেখতে। আপনি আমার স্বামীকে বিরক্ত করলে সে আপনাকে হত্যা করবে। সৈনিক বললেন, না একথা সত্যি নয়। তুমি সমবেদনা জানাতে আসনি, তুমি আমায় ভালােবাস তাই এসেছ।
ঠিক এমনি সময় পুলিশ এসে দরজা খুলে সৈনিক ও রাজকুমারকে জেলখানায় নিয়ে গেল। জেলখানায় তাদের কয়েক দিন কাটল। তারপর একদিন একজন পুরােনাে চাকর এসে সৈনিকের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করল। সে বলল, তুজুর আমি মনে করেছি আপনি মারা গেছেন। আপনাকে আবার জীবিত দেখলাম, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। সৈনিক বললেন, এন্ড্রু, আমি জানতাম তুমি আমার বিরুদ্ধে যাবে না।
প্রতিদিনই এন্ড্রু সৈনিকের সঙ্গে দেখা করে খাবার ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্য দিয়ে যেতে লাগল। এন্ড্রু বলল, এডিথ হিউগকে বিয়ে করেছে কিন্তু সে মােটেও সুখী নয়। সে এখনও আপনাকে ভালােবাসে। আপনার ভাই হিউগ আমাদের শাসিয়েছে। আমরা কেউ যদি আপনাকে চিনি বলে পরিচয় দিই তাহলে সে আমাদের হত্যা করবে। এখন রাজার অভিষেক হবার পরে নতুন রাজ্জার অনুগ্রহে সে অনেক কিছু করবে বলে আশা করছে। রাজকুমার জিজ্ঞাসা করলেন অভিষেক উৎসব কবে? সৈনিক মাইলসকে বললেন, তারা আর কাউকে সিংহাসনে বসাচ্ছে। আমাদের ওয়েস্টমিনস্টার গির্জায় যেতে হবে এবং যে করেই হােক এই অভিষেক উত্সব বন্ধ করতে হবে। সৈনিক বললেন, কালই আমার বিচার হবে, ঠিক সময়মতােই সেখানে পৌঁছাতে পারব।
পরের দিন বিচারে মাইসের দুদিনের জেল হবার আদেশ শােনার সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমার বললেন, হে জজ, আপনি কেমন করে এর প্রতি অবিচার করতে পারেন? আমি আপনাকে হুকুম দিচ্ছি একে মুক্তি দিল। বিচারক সঙ্গে সঙ্গে বললেন যে, এই বােকা ছেলেটাকে কয়েক ঘা বেত লাগাও। তাহলে তার জিহ্বা সংযত হবে। সৈনিক নিজে বিচারকের কাছে মিনতি করলেন যে বালকটি বড় দুর্বল। বালকের ভাগের চাবুক আমাকে মারার অনুমতি দিন। উত্তম প্রস্তাব, এই বেকুবকে এক ডজন চাবুক কষে লাগাও। চাবুক খাওয়া শেষে জেলখানার ভিতরে রাজকুমার সৈনিককে বললেন, তুমি সব লােক থেকে মহান এবং তােমাকে আজ থেকে আর খেতাবে ভূষিত করলাম।
এমনিভাবে কথা কাটাকাটি করতে করতে শেষে হাতাহাতি শুরু হলে এবং সব লােক এই গন্ডগােল দেখে এদিকে-সেদিকে ছুটে পালাতে লাগল। এর মধ্যে সৈনিক ও রাজকুমার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। যাক, গণ্ডগােল শেষে খুঁজে পাওয়া যাবে এই মনে করে রাজকুমার একাই নিজে অভিষেক দেখার জন্য রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা হলেন। পথ চলতে চলতে রাজ্যের সব অনাচার তার চোখের উপর ভেসে উঠল। আর তিনি মনে মনে ভাবছিলেন যে তিনি সিংহাসনে আরােহণ করার পরে এইসব অন্যায় ও অনাচার দূর করতে চেষ্টা করবেন।
এদিকে রাজপ্রাসাদে টম ক্যান্টির জন্য আজ দিনটা বড় আনন্দের। তাকে ভালাে ভালাে কাপড় পরানাে হলাে। বিভিন্ন খাবারও এল। সে মনে মনে ভাবল রাজা হওয়ায় ভারি মজা এবং অভিষেকে যাবার পথে সে আরও আনন্দিত হলাে। তার হাতে কয়েক থলি মুদ্রা গরিবের মধ্যে ছুড়ে ছুড়ে তা বিতরণ করার জন্য দেওয়া হলাে। সে গাড়িতে বসে ছুড়ে ছুড়ে তা বিতরণ করছিল। এমনি সময় ভিড়ের মধ্যে সে তার মাকে দেখতে পেল এবং তার অজান্তেই তার হাত মাথায় চলে গেল। এদিকে তার মাও তাকে চিনতে পারল, ‘টম আমার টম’ বলে গাড়ির দিকে ছুটে আসছিল, কিন্তু গাড়ির প্রহরীরা তাকে আটকে ফেলল। তখন টম তার মন্ত্রণাদাতাকে বলল, এই প্রৌঢ় মহিলাটি আমার মা। এই কথা শুনে হাটফোর্ড তাড়াতাড়ি আর্চবিশপের সঙ্গে পরামর্শ করে বললেন যে, রাজকুমারের পাগলামিটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কাজেই অভিষেকের কাজটি তাড়াতাড়ি শেষ করলেই ভালাে হয়।
এই কথা অনুযায়ী অনুষ্ঠানটি খুব তাড়াতাড়ি চলতে লাগল। তারা সবাই যখন দরবারকক্ষে এসে পৌঁছালেন ঠিক সেই সময় হঠাৎ এক বালককণ্ঠে উচ্চারিত হলাে : থামাে,আমিই হলাম আসল রাজকুমার। দরবারের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলে উঠলেন, এই ভিক্ষুক ছেলেটাকে বের করে দাও। কিন্তু সিংহাসন থেকে টম বলে উঠল, না না, সেই সত্যিকারের রাজকুমার। টম ক্যান্টি তখন সব ঘটনা হাটফোর্ডকে খুলে বলল। তখন হাটফোর্ড বললেন, এ যে অবিশ্বাস্য ঘটনা। তবে এই ব্যাপারে একটা মাত্র পরীক্ষা হবে-যার দ্বারা এই ঘটনার ফয়সালা হবে যে কে সত্যিকারের রাজকুমার। তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বলাে তাে বড় রাজকীয় সিলটা কোথায় আছে? ভিখারিরুপী রাজকুমার বলল, এ তাে অতি সাধারণ প্রশ্ন। আমার কামরায় গিয়ে টেবিলের বামদিকে একটা লােহার পেরেক আছে, সেটা চাপ দিলে একটা গুপ্ত আলমারির দরজা খুলে যাবে, সেখানেই সিলটা পাবেন।
হাটফোর্ড ত্বরিত সিল আনার জন্য চলে গেলেন কিন্তু কিছুক্ষণ পর খালি হাতে ফিরে এসে বললেন, সিলটা পাওয়া গেল । তখন হাটফোর্ড বললেন, এতে শুধু একটি সিদ্ধান্তেই আসা যায়। ভিখারিরুপী রাজকুমার হাটফোর্ডকে প্রশ্ন করল, আপনি ঠিকমতাে খুঁজে দেখেছেন তাে? হাটফোর্ড বললেন, হ্যা, কিন্তু কোথাও সেই বড় সােনালি গােল সিলটা পাওয়া গেল না। টম বলল, একটা বড় সােনালি গােল সিলের কথা বলছেন, আরে তােমার টেবিলের উপরই ছিল এবং পরে তুমি সেটাকে লুকালে। ভিখারি রাজকুমার বললেন, আর বলতে হবে না মনে পড়ছে। হাটফোর্ড, আমার ঘরে যে লােহার বর্ম আছে তার বাহুর তলে বড় সােনালি সিলটা আছে। আবার হাটফোর্ড দৌড়ে সিলটা খুঁজতে গেল এবং তাড়াতাড়িই ফেরত এসে বলল, আপনাকে সন্দেহ করার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন হুজুর।
এর মধ্যে সৈনিক মাইল্স হেডেন একদিন পরে এসে প্রাসাদে পৌঁছালেন। দ্বারী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এখানে কী করছ? সৈনিক বললেন, আমি আমার স্বর্গীয় পিতার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। দ্বারী বললেন, লােকটাকে সন্দেহ হচ্ছে, তােমরা একে তল্লাশি করাে। তারা তার দেহ তল্লাশি চালিয়ে একটা পত্র পেল। তাতে লেখা : লর্ড হাটফোর্ড সমীপেষু, এই পত্রবাহক আমার বন্ধু স্যার মাইস হেনডেন। সৈনিক মাইলসকে রাজকুমারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলাে। সৈনিক তখন ভাবছেন : আমি কি স্বপ্ন দেখছি, না সত্যি? তখন রাজকুমার বলল, হ মাইলস, তুমি আমার পাশে বসাে, এই অধিকার তােমাকে আগে দেওয়া হয়েছে ড়িত করা হলাে।
ডেন হিউগের মৃত্যুর পরে মাইলসের সঙ্গে এডিথের বিয়ে হলাে। তিনি তার মা ও বােনদের রাজপ্রাসাদে নিয়ে এসে বসবাস করতে লাগলেন। রাজকুমারকে যারা সাহায্য করেছিল, সবাইকে পুরস্কৃত করা হলাে। আর যারা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হলাে। রাজা এডওয়ার্ডের রাজত্ব খুব ন্যায় ও শান্তির রাজত্ব ছিল। একদিন রাজকুমার টমকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আমার বড় গােল সিলটার কথা কীভাবে মনে রাখলে? টম বলল, মনে থাকবে না? ওটা দিয়ে তাে আমি প্রতিদিন বাদামের খােসা ছাড়াতাম ও বাদাম ভাঙতাম। এটাকে আমি হাতুড়ির মতােই ব্যবহার করেছি।
সার-সংক্ষেপ রাজকুমার ও ভিখারির ছেলে মার্ক টোয়েন এর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস “দি প্রিন্স এন্ড দি পপার এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এ গল্পের মূল বিষয়বস্তু হলাে কেউ কারাে অবস্থানে সন্তুষ্ট নন, অন্যের অবস্থানে সুখ মনে করে। কল্পনাপ্রবণ শিক্ষার্থী যারা কল্পকাহিনী পড়তে ভালােবাসে তাদের জন্য একটি সুখপাঠ্য রচনা এই গল্পটি। এক রাজকুমার ও এক ভিখারির ছেলের কাহিনী নিয়ে গল্পটি রচিত। ষােড়শ শতাব্দীতে লন্ডনে একই সময়ে জন্ম হয় দুটি ছেলের। একজন রাজার ঘরে আর অন্যজন বস্তিতে এক ভিখারির ঘরে। ভিখারির ছেলেটির নাম টম ক্যান্টি। টম ক্যান্টি ছিল কল্পনাবিলাসী।
সে সবসময় মনে মনে রাজকুমার হওয়ার বাসনা পােষণ করত। অপর দিকে রাজকুমার রাজপ্রাসাদের সকল নিয়মকানুন, বিদ্যাশিক্ষা নিয়ে বড় হতে লাগল। একদিন টম হাঁটতে হাঁটতে রাজপ্রাসাদের গেটে এসে সুন্দর পােশাকপরা এক বালককে দেখতে পেল। এই সুন্দর পােশাকপরা ছেলেটিই রাজকুমার। এরপর দুজনের ভাব হয়। দুজন তাদের জীবনের গল্প বলে। একজনের জীবন অন্যজনের কাছে ভালাে লাগায় নিজেদের মধ্যে পােশাক বদল করে। এরপর ঘটতে থাকে দুজনের জীবনে নানা ঘটনা।
বিভিন্ন চরাই উতরাই পার করে অবশেষে টম ও রাজকুমার দুজনই বুঝতে পারে যে তারা নিজ নিজ জীবনেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবােধ করে। অন্যের জীবন বাইরে থেকে বর্ণিল মনে হলেও নিজের জীবনই সবচেয়ে বেশি আনন্দদায়ক ও পরিপূর্ণ।
0 Comments